নয়াদিল্লি/আলিগড়, ১৭ই অক্টোবর: আজ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং দূরদর্শী চিন্তাবিদ স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ২০৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৮১৭ সালের ১৭ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা এই মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রেক্ষাপটকে আমূল পরিবর্তন করা এক অসামান্য মুসলিম সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। আধুনিক বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে ভারতীয় মুসলমানদের জাগরণের লক্ষ্যে তাঁর অবিস্মরণীয় 'আলিগড় আন্দোলন' আজও প্রাসঙ্গিক।
আভিজাত্যপূর্ণ প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের জন্ম হয়েছিল মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র দিল্লি শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে, যাঁদের মোগল দরবারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল। তাঁর পিতা সৈয়দ মুহাম্মদ মুত্তাকী মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। সৈয়দ আহমদ খান প্রথাগত ও আধুনিক শিক্ষার একটি সংমিশ্রণ লাভ করেন। তিনি পবিত্র কোরআন, ফারসি, আরবি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং দর্শন অধ্যয়ন করেন। এই মিশ্র শিক্ষাই তাঁকে পরবর্তীতে যুক্তিবাদী ও আধুনিক শিক্ষায় জোর দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
জনসেবা ও ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ভূমিকা
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৩৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন এবং পরে বিজোরের স্মল কজেস কোর্টে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় তিনি ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিলেন এবং বহু ইউরোপীয় জীবন রক্ষায় সহায়তা করেন। তবে তাঁর সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ ছিল বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে প্রকাশিত তাঁর পুস্তিকা 'আসাব-এ-বাঘাওয়াত-এ-হিন্দ' (Causes of the Indian Revolt)। এই পুস্তিকায় তিনি ব্রিটিশদের বিভিন্ন নীতি ও অবিচারের কঠোর সমালোচনা করে সাহসের সঙ্গে প্রমাণ করেন যে এইগুলিই বিদ্রোহের মূল কারণ।
শিক্ষাগত বিপ্লব: আলিগড় আন্দোলন
মহাবিদ্রোহের পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের করুণ অবস্থা দেখে তিনি উপলব্ধি করেন যে আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষার অভাবই তাদের পতনের প্রধান কারণ। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তিনি একাধিক শিক্ষামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেন:
১. প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান: ১৮৫৯ সালে তিনি মোরাদাবাদে তাঁর প্রথম আধুনিক মাদ্রাসা স্থাপন করেন, যেখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো হয়। এরপর ১৮৬৩ সালে গাজিপুরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
২. সাইন্টিফিক সোসাইটি (১৮৬৪): পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক সাহিত্যগুলি উর্দু ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তিনি এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য ছিল আধুনিক জ্ঞানকে ভারতীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
৩. মুহাম্মাদান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (MAOC): ১৮৭৫ সালে আলিগড়ে এই ঐতিহাসিক কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি অবশেষে ১৯২০ সালে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি (AMU)-তে রূপান্তরিত হয়, যা মুসলিম বুদ্ধিজীবী জাগরণের 'আলিগড় আন্দোলন'-এর প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।
স্যার সৈয়দ মনে করতেন, মুসলমানরা যদি ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে পেশা এবং আধুনিক বিজ্ঞানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, তবে তাদের ইংরেজি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করতেই হবে। তাঁর কলেজগুলিতে প্রথাগত বিষয়ের সঙ্গে পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন এবং আধুনিক মানবিক বিদ্যাও পড়ানো হত।
দার্শনিক ও সামাজিক দূরদৃষ্টি
১৮৭০ সালে তিনি 'তাহজিব-উল-আখলাক' (The Mohammedan Social Reformer) নামে একটি পত্রিকা চালু করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সমাজ সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি প্রচার করেন যে ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিজ্ঞান ও যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে—ইসলাম যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে। তিনি কুসংস্কার, বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধেও কথা বলেন। সময়ের রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও, তিনি নারীদের জন্য সাক্ষরতা এবং 'জানানা মাদ্রাসা'র মতো উদ্যোগের মাধ্যমে মেয়েদের সীমিত বিদ্যালয় শিক্ষারও সমর্থন করেছিলেন।
রাজনৈতিক ধারণা এবং স্থপতি
ব্রিটিশ রাজের প্রতি অনুগত থাকা সত্ত্বেও, স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐক্যের প্রচার করেছিলেন। আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে তিনি এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করেছিলেন, যারা পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাঁর শিক্ষাগত আধুনিকতাবাদের জন্যই তাঁকে প্রায়শই 'মুসলিম জাতীয়তাবাদের স্থপতি' এবং 'দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক মুসলিম শিক্ষার জনক' হিসেবে গণ্য করা হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের এই দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, যা ইসলামী ঐতিহ্য এবং পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল, তা আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এবং সমগ্র উপমহাদেশে আধুনিক সংস্কারের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে।