নয়াদিল্লি, ২০ অক্টোবর, ২০২৫: বিশ্বজুড়ে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ফ্রান্সেসকা ওরসিনিকে ২০২৫ সালের ২০ অক্টোবর দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর তাকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হংকংয়ে ফেরত পাঠানো হয়, যা শিক্ষাবিদ মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
বিতাড়নের মূল কারণ: ভিসা শর্ত লঙ্ঘন
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের (MHA) কর্মকর্তাদের মতে, ফ্রান্সেসকা ওরসিনিকে ২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে কালো তালিকাভুক্ত (Blacklisted) করা হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে যে, তিনি তার পূর্ববর্তী ভারত সফরে ভিসার শর্তাবলী লঙ্ঘন করেছিলেন [১][৩][৫]। কর্মকর্তারা বলেছেন যে, ওরসিনি একটি পর্যটক ভিসা (Tourist Visa) নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু তিনি এই ভিসার আওতার বাইরে গিয়ে শিক্ষাগত কার্যক্রমে (Academic Activities) জড়িত ছিলেন। ভারতীয় অভিবাসন আইন অনুযায়ী, পর্যটক ভিসায় পেশাগত কাজ, গবেষণা বা শিক্ষাগত কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই ধরনের কাজের জন্য নির্দিষ্ট গবেষণা ভিসা (Research Visa) বা অন্যান্য উপযুক্ত ভিসার প্রয়োজন হয়।
বিমানবন্দরে নাটকীয় ঘটনা
ফ্রান্সেসকা ওরসিনি হংকং থেকে দিল্লীতে পৌঁছান, যেখানে তিনি চীনের একটি শিক্ষাগত সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তার কাছে একটি বৈধ পাঁচ বছরের পর্যটক ভিসা ছিল, তবুও অভিবাসন কর্মকর্তারা তাকে ভারতে প্রবেশ করতে দেননি। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, কর্মকর্তারা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তার ভারতে আসার উদ্দেশ্য ভিসার বিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এরপর তাকে দ্রুত একটি ফিরতি ফ্লাইটে হংকংয়ে ফেরত পাঠানো হয় ।
শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সেসকা ওরসিনিকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার ঘটনাটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিদ মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ এই ঘটনাকে "একটি insecure, paranoid এবং এমনকি মূর্খ সরকারের লক্ষণ" বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সরকারের এই পদক্ষেপকে শিক্ষাবিদদের প্রতি "অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষের" প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে, লেখক মুকুল কেসাভান সরকারের এই আচরণে "visceral hostility" (আবেগপ্রবণ শত্রুতা) দেখতে পেয়েছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভারত কেন একজন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিতের প্রতি এমন কঠোর অবস্থান নিচ্ছে ।
ওরসিনির অনেক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশকারী সংস্থা 'পার্মানেন্ট ব্ল্যাক' এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি বিবৃতিতে বলেছে যে, ওরসিনির গবেষণা হিন্দি ও উর্দু সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য অপরিহার্য এবং তাকে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াই ফেরত পাঠানো একটি হতাশাজনক ঘটনা ।
ফ্রান্সেসকা ওরসিনির পরিচয় ও অবদান
ফ্রান্সেসকা ওরসিনি ইতালীয় বংশোদ্ভূত হলেও হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের একজন নিবেদিত পণ্ডিত। তিনি ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (JNU) এবং সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ হিন্দিতে পড়াশোনা করেছেন। এরপর তিনি লন্ডনের SOAS-এ যোগদান করেন এবং দীর্ঘ কর্মজীবনে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্মগুলির মধ্যে রয়েছে The Hindi Public Sphere: 1920–1940 এবং Print and Publishing in Colonial India। এই কাজগুলি দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছে ।
এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল যখন ভারত সরকার বিদেশি নাগরিকদের ভিসা নীতি কঠোর করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওরসিনির ঘটনাটি ভারতে বিদেশি শিক্ষাবিদদের কাজ করার পরিবেশ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যদিও সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে যে এটি ভিসার শর্ত লঙ্ঘনের একটি "সাধারণ প্রক্রিয়া", তবে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি, যা সমালোচকদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছে ।
সংক্ষেপে, ফ্রান্সেসকা ওরসিনিকে ভারতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার মূল কারণ হলো পূর্বে পর্যটক ভিসায় থাকাকালীন শিক্ষাগত কার্যক্রমে জড়িত হয়ে ভিসার শর্ত লঙ্ঘন করা। এই লঙ্ঘনের ফলস্বরূপ তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল এবং ২০২৫ সালের অক্টোবরে তার ভারতে ফেরার চেষ্টাকালে তাকে বিতাড়িত করা হয় ।