১. পরিসংখ্যানের দ্বিধা ও বিচারহীনতার বিপদ
জাতীয় অপরাধ রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-এর ২০২৩ সালের সাম্প্রতিক তথ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলে নারী সুরক্ষার এক দ্বিধামূলক এবং মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা, এই দুটি প্রতিবেশী রাজ্য নারী নির্যাতনের মাত্রা, প্রকৃতি এবং বিচারিক ফলাফলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পথ অবলম্বন করেছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যদিও absolute সংখ্যা বা মোট মামলার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ (৩৪,৬৯১টি মামলা) ওড়িশার (২৫,৯১৪টি মামলা) চেয়ে বেশি মামলা নথিভুক্ত করেছে, কিন্তু যখন প্রতি লক্ষ মহিলায় অপরাধের হার (Crime Rate) বিশ্লেষণ করা হয়, তখন ওড়িশার পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বহুগুণে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এই তুলনামূলক প্রতিবেদন শুধু অপরাধের সংখ্যার ওপর গুরুত্বারোপ করে না, বরং বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা তুলে ধরে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ
১.১. বিশ্লেষণীয় প্রেক্ষাপট প্রতিষ্ঠা
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে মামলার মোট সংখ্যা প্রায়শই সংবাদ শিরোনামে আসে। কিন্তু প্রকৃত ঝুঁকি নিরূপণের জন্য প্রতি এক লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় নথিভুক্ত অপরাধের হার (Crime Rate per 100,000 women) হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি। এই সূচকটি ব্যবহার করেই রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধের ব্যাপকতা বোঝা সম্ভব।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের অপরাধের হার প্রায় ৬৬.২, যা ভারতের জাতীয় গড়ের কাছাকাছি। কিন্তু ওড়িশার ক্ষেত্রে এই হার পৌঁছেছে ১১২.৪-এ—যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, ওড়িশার মহিলারা তুলনামূলকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছেন। এই বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি (যা শুধুমাত্র সংখ্যাভিত্তিক রিপোর্টিং-এর অভাব পূরণ করে
এই তথ্যগুলি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে থাকা জাতীয় অপরাধ রেকর্ডস ব্যুরো (National Crime Records Bureau - NCRB)
২. তুলনামূলক অপরাধ চিত্র: সংখ্যা বনাম হার এবং ক্রমবর্ধমান প্রবণতা
২.১. মোট মামলার সংখ্যা এবং হারের পার্থক্য
পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা উভয়েরই নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে উচ্চ সংখ্যা নথিভুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩৪,৬৯১টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে, যা ওড়িশার মোট ২৫,৯১৪টি মামলার চেয়ে বেশি। এই সংখ্যাগত পার্থক্য সত্ত্বেও, অপরাধের হারের ভিত্তিতে ওড়িশা জাতীয় উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রতি লক্ষ মহিলায় ১১২.৪ হারে, ওড়িশা ভারতের সেই রাজ্যগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে যেখানে নারী নির্যাতনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের হার তুলনামূলকভাবে মডারেট (৬৬.২)। এই পরিসংখ্যান দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গ, জনসংখ্যার বৃহত্তর ভিত্তি এবং উচ্চ মামলার সংখ্যা সত্ত্বেও, জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে, অন্তত ওড়িশার প্রেক্ষাপটে। এই পার্থক্যটি ইঙ্গিত দেয় যে ওড়িশার ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন শুধু একটি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজ এবং প্রশাসনের গভীরে প্রোথিত একটি ব্যাপক সমস্যা।
২.২. অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা
অপরাধের হারের তারতম্যের পাশাপাশি, দুটি রাজ্যের প্রবণতার মধ্যে এক ভয়াবহ বৈসাদৃশ্য দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রবণতা নির্দিষ্ট কিছু হিংসাত্মক বিভাগে স্থিতিশীল বা সামান্য হ্রাসের দিকে ঝুঁকেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির কিছু প্রচেষ্টা হয়ত ইতিবাচক ফল দিচ্ছে, যদিও তা ধীর গতিতে।
অন্যদিকে, ওড়িশা গত কয়েক বছরে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এই রাজ্যে অপরাধের হার ৯.৬% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটি অ্যালার্মিং গতি নির্দেশ করে। যখন একটি রাজ্যে অপরাধের হার এমনিতেই জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি (১১২.৪), এবং তার ওপর তা প্রায় ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তখন এটি কেবল একটি পরিসংখ্যানগত বৃদ্ধি নয়, বরং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া একটি সামাজিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এই দ্রুত বৃদ্ধি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, রাজ্যে কার্যকরভাবে অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, তার সম্পূর্ণ অভাব রয়েছে। এই উদ্বেগজনক গতি ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
পর্যালোচনার সুবিধার্থে মূল ডেটা নিচে সারণী আকারে উপস্থাপন করা হলো:
Table 1: পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় নারী নির্যাতনের মূল পরিসংখ্যান (২০২৩)
বিবরণ (Aspect) | পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) | ওড়িশা (Odisha) |
মোট নথিভুক্ত মামলা (Total Cases) | 34,691 | 25,914 |
প্রতি লক্ষ মহিলায় অপরাধের হার (Crime Rate / 100,000 women) | ~66.2 (জাতীয় গড়ের কাছাকাছি) | 112.4 (সর্বোচ্চ রাজ্যগুলির মধ্যে একটি) |
মামলার প্রবণতা (Trend) | স্থিতিশীল/সামান্য হ্রাস | দ্রুত বৃদ্ধি (৯.৬% YoY বৃদ্ধি) |
৩. বিচার ব্যবস্থার অগ্নিপরীক্ষা: পুলিশি দক্ষতা বনাম বিচারিক নিষ্ক্রিয়তা
নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে অপরাধের হার যতটাই গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচার ব্যবস্থার সক্ষমতা। বিচারিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়, যা অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা উভয়েই জটিল কাঠামোগত সমস্যার সম্মুখীন হলেও, তাদের ব্যর্থতার প্রকৃতি ভিন্ন।
৩.১. পশ্চিমবঙ্গের দক্ষতা ও বিচারিক অচলাবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির প্রাথমিক কর্মদক্ষতা প্রশংসনীয়। NCRB-এর তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে ৯৩.৮% মামলায় চার্জশিট দাখিল করেছে। এত উচ্চ চার্জশিট দাখিলের হার (Charge-Sheeting Rate) প্রমাণ করে যে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ (WBP)
তবে, এই উচ্চ পুলিশি দক্ষতার বিপরীতে রাজ্যের চূড়ান্ত সাজার হার (Conviction Rate) জাতীয় গড়ের কাছাকাছি (২১.৩%) থাকা একটি 'পুলিশ-বিচারালয় প্যারাডক্স' সৃষ্টি করেছে। যদি ৯৩ শতাংশের বেশি মামলা আদালতে যায়, কিন্তু মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মামলায় সাজা নিশ্চিত হয়, তবে এটি স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে সমস্যাটি পুলিশের তদন্ত শেষ করার ক্ষমতা নিয়ে নয়, বরং সেই তদন্তের গুণগত মান, অথবা বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও সক্ষমতা নিয়ে। আদালতে গিয়ে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণ দুর্বল প্রমাণিত হচ্ছে, নয়তো সাক্ষী সুরক্ষা বা দ্রুত শুনানির অভাবে মামলাগুলি ব্যর্থ হচ্ছে। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে, যেখানে অতীতে পশ্চিমবঙ্গে Crimes Against Women (CAW) ক্ষেত্রে সাজার হার (যেমন, কোলকাতায় ৭.৮%)
৩.২. ওড়িশার বিচারিক বিপর্যয়: ৬.৯% সাজার হারের বিশ্লেষণ
ওড়িশার পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বহুগুণে বেশি ভয়াবহ। ওড়িশায় নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে সাজার হার মাত্র ৬.৯%। এই পরিসংখ্যান কেবল কম নয়, এটি বিচারিক কাঠামোয় এক সামগ্রিক বিপর্যয় নির্দেশ করে।
এই অত্যন্ত নিম্ন সাজার হার একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয়: ওড়িশার বিচার ব্যবস্থা নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যদি ৯৩ শতাংশের বেশি অপরাধী শাস্তির বাইরে থেকে যায়, তবে এটি সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে (Culture of Impunity) শক্তিশালী করে। অপরাধীরা দেখতে পায় যে অপরাধের সামাজিক বা আইনি মূল্য প্রায় শূন্য, যা তাদের বারবার একই অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। ওড়িশায় নারী নির্যাতনের হার ৯.৬% বৃদ্ধির পিছনে এই ৬.৯% সাজার হার একটি প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করে। এই হার প্রমাণ করে যে ওড়িশায় হয় প্রাথমিক তদন্তের গুণগত মান অত্যন্ত দুর্বল, অথবা বিচারকদের স্বল্পতা, ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টের অকার্যকারিতা, অথবা মামলা পরিচালনায় গুরুতর প্রশাসনিক ঘাটতি বিদ্যমান, যা অপরাধের দ্রুত বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
মামলার অগ্রগতির ক্ষেত্রে দুই রাজ্যের পারফর্ম্যান্সের তারতম্য নিম্নরূপ:
Table 2: মামলার অগ্রগতিতে দুই রাজ্যের পারফর্ম্যান্স
বিবরণ (Aspect) | পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) | ওড়িশা (Odisha) | তাৎপর্য (Significance) |
চার্জশিট দাখিলের হার (Charge-Sheeting Rate) | 93.8% | কম ও পতনশীল | WB-তে পুলিশি প্রক্রিয়াকরণ অত্যন্ত দ্রুত ও দক্ষ; Odisha-তে তদন্তে দুর্বলতা। |
চূড়ান্ত সাজার হার (Conviction Rate) | 21.3% (জাতীয় গড়ের সমান) | 6.9% (মারাত্মকভাবে নিম্ন) | Odisha-তে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ; WB-তে বিচারিক বাধার ইঙ্গিত। |
৪. অপরাধের ধরন ও সামাজিক সংকট: ঘরে-বাইরে বিপদ
অপরাধের পরিসংখ্যানগত পার্থক্য ছাড়াও, অপরাধের প্রকৃতিতেও দুই রাজ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের ভিন্নতা তুলে ধরে।
৪.১. পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সমস্যা: গার্হস্থ্য নিষ্ঠুরতা
পশ্চিমবঙ্গে নারীর বিরুদ্ধে নথিভুক্ত অপরাধগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বিভাগ হলো "স্বামী বা আত্মীয় দ্বারা নিষ্ঠুরতা" (Cruelty by husband or relatives)। এই মামলাগুলি মূলত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ ধারা (যা বর্তমানে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর সেকশন ৮৫ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে
এই ধরনের অপরাধের উচ্চ সংখ্যা ইঙ্গিত দেয় যে পশ্চিমবঙ্গে নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি সমাজের অভ্যন্তরীণ কাঠামো, অর্থাৎ পরিবার বা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান। যদিও ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধের হার পশ্চিমবঙ্গে স্থিতিশীল বা হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু গার্হস্থ্য সহিংসতা সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এই ধরনের অপরাধগুলি মোকাবিলা করার জন্য শুধুমাত্র পুলিশি টহল বা অপরাধ দমন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, মহিলা থানাগুলিতে বিশেষায়িত কাউন্সেলিং এবং পারিবারিক আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া।
৪.২. ওড়িশার নতুন ও পুরনো সংকট: সাইবার অপরাধ ও অপহরণ
ওড়িশার অপরাধের ধরন আরও জটিল এবং বহুমুখী। এই রাজ্যে প্রথাগত আক্রমণ (Assault) এবং অপহরণের হার উচ্চ। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো ইন্টারনেট-ভিত্তিক অপরাধের ক্ষেত্রে ওড়িশার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, যেখানে রাজ্যটি কিছু উপ-বিভাগে জাতীয়ভাবে শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এই অপরাধগুলিতে অনলাইন হয়রানি, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা ছবি পাঠানো, ভুয়ো আইডি তৈরি, এবং ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশের হুমকি
৫. আঞ্চলিক প্রশাসনের ভূমিকা এবং দায়বদ্ধতা
দুই রাজ্যের অপরাধের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ মোকাবেলায় প্রশাসনিক কাঠামোয় তাদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যর্থতা রয়েছে।
৫.১. পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও প্রসিকিউশনের বিচ্ছিন্নতা
পশ্চিমবঙ্গের ৯৩.৮% উচ্চ চার্জশিট দাখিলের হার এক দিকে যেমন পুলিশ প্রশাসনের দ্রুত কার্যকারিতা তুলে ধরে, তেমনি মাত্র ২১.৩% সাজার হার ইঙ্গিত দেয় যে পুলিশি তদন্ত এবং সরকারি প্রসিকিউশনের (Prosecution) মধ্যে গুণগত মানের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
তদন্তকারী সংস্থা দ্রুত চার্জশিট দাখিল করলেও, সেই চার্জশিটগুলিতে যথেষ্ট শক্তিশালী, আদালত-প্রমাণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ, বিশেষ করে ফরেনসিক বা ডিজিটাল প্রমাণ, অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে কিনা—সে বিষয়ে গভীর প্রশ্ন থেকে যায়। এই পরিস্থিতি দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গের চ্যালেঞ্জ হলো পরিমাণ (Quantity) থেকে গুণমান (Quality) এর দিকে নজর দেওয়া। সাজার হার বাড়াতে হলে সাক্ষ্যপ্রমাণের মান উন্নত করতে হবে, সাক্ষী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং চার্জশিট দাখিলের আগে সরকারি আইনজীবীদের মাধ্যমে আইনি পর্যালোচনা (Legal Scrutiny) বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চ চার্জশিটিংকে কোনোভাবেই উচ্চমানের তদন্তের সমার্থক হিসেবে গণ্য করা যায় না।
৫.২. ওড়িশার প্রশাসনিক কাঠামোগত দুর্বলতা
ওড়িশার পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে হতাশাজনক। উচ্চ অপরাধের হার (১১২.৪), গ্রেফতারের সংখ্যায় পতন এবং ৬.৯% সাজার হার একত্রে আইন প্রয়োগকারী এবং বিচারিক উভয় কাঠামোর ক্ষেত্রেই কাঠামোগত দুর্বলতা নির্দেশ করে।
এত কম সাজার হার প্রায় নিশ্চিতভাবে আদালতের স্বল্পতা, বিচারকের শূন্যপদ, এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলির কার্যকারিতার অভাবের ইঙ্গিত দেয়। যখন বিচার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে, তখন সাক্ষ্যপ্রমাণ দুর্বল হয়ে যায়, সাক্ষীরা ভয় পায় বা প্রভাবিত হয়, এবং ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ওড়িশার প্রশাসন নারীর প্রতি অপরাধকে একটি কম-ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপে রূপান্তরিত করেছে, যার ফলে নাগরিকরা, বিশেষ করে মহিলারা, আইন ও প্রশাসনের ওপর আস্থা হারাতে বাধ্য হচ্ছে। দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে ওড়িশায় নারী নির্যাতনের হার বাড়তেই থাকবে, যা জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬. নীতিগত সুপারিশ এবং সমাধানের পথ
NCRB ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার তুলনামূলক বিশ্লেষণ এই অঞ্চলের নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছে। সমাধানের পথও তাই ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ দাবি করে।
৬.১. ওড়িশার জন্য জরুরি বিচার বিভাগীয় সংস্কার
ওড়িশার বিচারিক বিপর্যয় (৬.৯% সাজার হার) মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে একটি জরুরি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন:
১. ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টগুলির সংস্কার: কেবল নামমাত্র ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট গঠন না করে, এই আদালতগুলিতে প্রয়োজনীয় বিচারক ও কর্মীর নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং নারী নির্যাতন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
২. বিশেষজ্ঞ তদন্তকারী দল: ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট-ভিত্তিক অপরাধ 7 এবং অপহরণের মতো জটিল মামলার জন্য ডিজিটাল ফরেনসিক ক্ষমতাসম্পন্ন এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষ পুলিশ ইউনিট তৈরি করা প্রয়োজন। প্রথাগত পুলিশ কাঠামো আধুনিক সাইবার অপরাধের মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।
৩. প্রসিকিউশন সক্ষমতা বৃদ্ধি: সরকারি আইনজীবীদের (Public Prosecutors) সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তদন্তের সময় পুলিশ ও প্রসিকিউশনের মধ্যে বাধ্যতামূলক সমন্বয় সাধন করতে হবে যাতে দুর্বল চার্জশিট আদালতে না যায়।
৬.২. পশ্চিমবঙ্গের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গের চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ প্রশাসনিক সক্ষমতাকে চূড়ান্ত বিচারিক সাফল্যে রূপান্তরিত করা।
১. গুণগত মান নিশ্চিতকরণ: পুলিশের চার্জশিট দাখিলের পূর্বে প্রমাণের গুণগত মান পর্যালোচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র আইনি স্ক্রুটিনি প্রক্রিয়া চালু করা। এটি নিশ্চিত করবে যে আদালতে কেবল দ্রুত মামলা ঠেলে দেওয়াই নয়, বরং শক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা তৈরি করা হয়েছে।
২. গার্হস্থ্য সহিংসতা মোকাবেলা: যেহেতু "স্বামী বা আত্মীয় দ্বারা নিষ্ঠুরতা" 5 প্রধান অপরাধ, তাই সামাজিক সচেতনতা এবং নারী অধিকার কর্মীদের মাধ্যমে কমিউনিটি স্তরে সালিশি ব্যবস্থার সংস্কার করা আবশ্যক। মহিলাদের আশ্রয়স্থল এবং আইনি সহায়তার সুযোগ বৃদ্ধি করা উচিত।
৭. জাতীয় উদ্বেগের বিষয়
এই তুলনামূলক চিত্র স্পষ্ট করে দেয় যে, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে পূর্ব ভারতের দুটি রাজ্য দুটি ভিন্ন ধরনের সংকটে ভুগছে। পশ্চিমবঙ্গে মামলা নথিভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত দক্ষ হলেও, বিচারিক ফলাফল এখনও জাতীয় গড়ের নিচে স্থবির, যা বিচারিক বাধা (judicial bottleneck) এবং প্রমাণের দুর্বল গুণমান নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ওড়িশার পরিস্থিতি বহুলাংশে বেশি ভয়াবহ। উচ্চ অপরাধের হার, দ্রুত বৃদ্ধি এবং ৬.৯% সাজার হার এক ভয়াবহ 'বিচারহীনতার সংস্কৃতি' (Culture of Impunity) সৃষ্টি করেছে, যেখানে অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজন হলো গুণগত উৎকর্ষ, যেখানে ওড়িশার প্রয়োজন হলো প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামোর মৌলিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার। যতক্ষণ না ওড়িশা তার বিচারিক দুর্বলতাগুলি দূর করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাজ্যটি নারীর সুরক্ষা এবং বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে এক মারাত্মক উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই সংকট অবিলম্বে জাতীয় মনোযোগ এবং জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করে।
Table 3: নারী সুরক্ষা ও বিচারপ্রাপ্তির সংকট চিত্র, ২০২৩
সংকটের দিক (Aspect of Crisis) | পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) | ওড়িশা (Odisha) | পর্যবেক্ষণ (Observation) |
মূল ঝুঁকি (Primary Risk) | গার্হস্থ্য ও সামাজিক অস্থিরতা | সমাজের ব্যাপক ঝুঁকি | রেট (Rate) দ্বারা নির্ধারিত |
বিচারিক পরিণতি (Judicial Outcome) | গড় মানের নিচে স্থবিরতা | বিচারিক কাঠামোয় বিপর্যয় | সাজার হার (Conviction Rate) দ্বারা নির্ধারিত |
প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া (Administrative Response) | দক্ষ ডকুমেন্টেশন, দুর্বল প্রসিকিউশন | সামগ্রিক ব্যর্থতা | চার্জশিট ও সাজার হার দ্বারা নির্ধারিত |