" " //psuftoum.com/4/5191039 Live Web Directory শক্তিপীঠ: কেবল ধর্ম নয়, শ্রেণি ও লিঙ্গ-শোষণের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী ইশতেহার Shakti Peeth: A Revolutionary Manifesto Against Class and Gender Exploitation //whairtoa.com/4/5181814
Type Here to Get Search Results !

শক্তিপীঠ: কেবল ধর্ম নয়, শ্রেণি ও লিঙ্গ-শোষণের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী ইশতেহার Shakti Peeth: A Revolutionary Manifesto Against Class and Gender Exploitation

 






ভারতের জনমানসে শক্তিপীঠের ধারণা নিছক পৌরাণিক উপাখ্যান বা ভক্তির কেন্দ্র নয়; বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক পাঠে এগুলি হল শোষণের বিরুদ্ধে নারীর আদিম প্রতিরোধ এবং সামাজিক সমতার এক বহমান ইতিহাস। এই ৫১টি সতীপীঠ, যেখানে দেবী সতীর দেহাংশ বা অলঙ্কার পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়, কেবল উপাসনাস্থল নয়—এগুলি সেই বিপ্লবী চেতনার উৎস, যা শতাব্দী ধরে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে প্রতীকী রূপ দিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, এমনকি আন্তর্জাতিক ভূখণ্ডে ছড়িয়ে থাকা এই পীঠগুলির ঐতিহাসিক উপস্থিতি এক বিশ্বজনীন মুক্তির বার্তা বহন করে।


শক্তিপীঠের ভৌগোলিক বিস্তার ও দেহ-চেতনার সমাজতান্ত্রিক পাঠ

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যজুড়ে দেবী সতীর দেহাংশ পতনের ভিত্তিতে ৫১টি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । এগুলি দেবী শক্তির বিভিন্ন রূপ এবং শিবের বিভিন্ন রূপের উপাসনাস্থল হিসেবে বিবেচিত। এই বিশাল বিস্তার প্রমাণ করে যে, নারীশক্তির এই উপাসনা কেবল একটি আঞ্চলিক প্রথা নয়, বরং এটি ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের জনসংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, যা আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের মধ্যে সমতার এক ধারণা দেয়।

ভারতের প্রধান সতীপীঠসমূহ

বামপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে এই পীঠগুলির গুরুত্ব এইখানে যে, সতীর দেহের প্রতিটি অংশ পতনের স্থানগুলি সমাজে দেহের উপর নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে একপ্রকার শারীরিক মুক্তির ঘোষণা করে। নিচে ভারতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সতীপীঠের তালিকা রাজ্যভিত্তিকভাবে দেওয়া হলো:

রাজ্য / অঞ্চলসতীপীঠের নামদেবীর নাম ও দেহাংশ
পশ্চিমবঙ্গকালীঘাট, গঙ্গাসাগর, নলহাটি, বরাহভীমা (তমলুক), ফুলটিলা (বিরভূম)ডান পায়ের আঙুল, ডান কানের দুল, নাসিকা, পায়ের গোড়ালি, চিবুক
আসামকামাখ্যাজননাঙ্গ
বিহারমঙ্গলা গৌরী (গয়া)স্তন
উত্তর প্রদেশবিশালাক্ষী (বারাণসী), ললিতা (প্রয়াগ), কাত্যায়নী (মথুরা)কানের দুল, অঙ্গুলি, চুল
হিমাচল প্রদেশজ্বালা দেবী (কাংগ্রা), নবদুর্গা (চিন্তপুরণ)জিহ্বা, চোখ
ওড়িশাতারাতারিণী (ব্রহ্মপুর)স্তন
রাজস্থানঅম্বিকা (ভরতপুর), গায়ত্রী (পুষ্কর)বাম পা, কব্জি
গুজরাটআম্বাজিহৃদয়
মহারাষ্ট্রমহালক্ষ্মী (কোলহাপুর), ব্রামারী (নাসিক)তৃতীয় নয়ন, চিবুক
তামিলনাড়ুকন্যাকুমারী (নারায়ণী), কাঞ্চিপুরম (কমাক্ষী)উপর দাঁত, মস্তক
অন্ধ্র প্রদেশআলমপুর (যোগুলাম্বা), শ্রীশৈল (ভ্রমারাম্বিকা)পা, ঘাড়
হরিয়ানাকুরুক্ষেত্র (সাবিত্রী)ডান গোড়ালি
জম্মু ও কাশ্মীরঅমরনাথ (মহামায়া)কণ্ঠ
মধ্যপ্রদেশউজ্জয়িনী (মহাকালী)চোখ
শ্রীলঙ্কাশংকরী দেবী (লংকা)গৃহত্যাগের অংশ

আন্তর্জাতিক ভূখণ্ডে শক্তির জাগরণ

এই ৫১ শক্তিপীঠের কিছু আজ ভারতের বাইরে, যেমন বাংলাদেশে (যশোরেশ্বরী), নেপালে (গুহ্যেশ্বরী), পাকিস্তানে (হিঙলাজ মাতার পীঠ), ও শ্রীলঙ্কায় (শংকরী দেবী পীঠ) অবস্থিত । এই ভৌগোলিক বিস্তার প্রমাণ করে, দেবী শক্তি কেবল একটি দেশের বা ধর্মের সম্পত্তি নন, তিনি উপমহাদেশের নিপীড়িত মানুষের আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতীক। সব শক্তিপীঠেই দেবী সতীর কোনো না কোনো দেহাংশ বা অলঙ্কার পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।

এই পীঠগুলি শাক্তধর্মে শক্তির প্রতীক এবং ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অনন্য উদাহরণ ।


১. সতীর আত্মাহুতি: পিতৃতন্ত্র ও শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

পৌরাণিক কাঠামোয় সতীপীঠের জন্মকথা গভীরভাবে পিতৃতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে এক আদিম নারীশক্তির জাগরণকে নির্দেশ করে। সতী তাঁর স্বামী শিবের প্রতি পিতার (রাজা দক্ষ) অবমাননা সহ্য করতে পারেননি। রাজা দক্ষ সেই সময়ে সমাজের শ্রেণিবৈষম্য ও অভিজাত প্রথার প্রতীক ছিলেন, যিনি তাঁর কর্তৃত্বের বাইরে থাকা এক ‘অনাচারী’কে (শিব) মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। সতীর আত্মদাহ আসলে সেই ক্ষমতা ও অহংকারের কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত ‘অগ্নি-বিদ্রোহ’।

বাম চিন্তাধারা অনুযায়ী, সতীর এই আত্মাহুতি কোনো নিষ্ক্রিয় আত্মহত্যা ছিল না, বরং ছিল তাঁর সময়ের সামাজিক শৃঙ্খল ও পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার এক রেডিক্যাল রাজনৈতিক পদক্ষেপ। শক্তিপীঠগুলি তাই নারীমুক্তির পথ দেখায়, যেখানে শরীর, সম্মান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার—এই সবকিছুর উপর নারীর নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চেতনা আজও সমাজের দুর্বলতম অংশের নারী-শ্রমিক, কৃষক, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য লড়াকু প্রেরণা হতে পারে।

২. জনমানুষের শক্তি ও সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র

শক্তিপীঠগুলির টিকে থাকা বা বিকাশ কোনো রাজকীয় ফরমান বা বৃহৎ পুঁজির দান নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি। বরং এগুলি স্থানীয় মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণী, এবং তথাকথিত 'নিম্নবর্গীয়' জনগোষ্ঠীর ভক্তি, শ্রম ও নিরলস অংশগ্রহণের ফসল। এই পীঠগুলি গড়ে উঠেছে জনমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আশ্রয় করে, যেখানে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক বিরোধিতা এবং ঐক্যের চর্চা নিহিত।

পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাট, বা আসামের কামাখ্যার মতো পীঠগুলিতে যে লোকায়ত আচার, মন্ত্র ও ঐতিহ্য মিশে আছে, তা আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও অভিজাত ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেরই ফল। শক্তিপীঠের এই জনসংস্কৃতি প্রমাণ করে যে, প্রকৃত শক্তি রাজকোষে নয়, বরং জনগণের ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস ও শ্রমে নিহিত। এই অর্থে, শক্তিপীঠগুলি হলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, বহু-শ্রেণিগত জনসংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক

৩. অর্থনীতির শ্রেণিসংগ্রাম: মন্দির-বাণিজ্যের পুঁজিবাদী চেহারা

আজকের শক্তিপীঠগুলির একটি বড় অংশই দুর্ভাগ্যবশত মুনাফালোভী পুঁজিবাদী ধর্মব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দর্শন, পূজা ও ভোগের নামে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হলেও, তা সমাজের প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো কাজে আসছে না। মন্দিরের ট্রাস্ট বা পরিচালন কমিটিগুলিতে প্রায়শই অভিজাত, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়, যারা ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়াচ্ছেন।

বামপন্থার দাবি এই প্রবণতার উল্টো পথে হাঁটা। দেবী শক্তির প্রকৃত আরাধনা তখনই সম্ভব, যখন মন্দিরগুলি জনগণের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন:

  • স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ: মন্দিরের পরিচালনা ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্থানীয় মানুষ ও শ্রমজীবী মহিলাদের হাতে তুলে দেওয়া।

  • নারীর পৌরহিত্য: কামাখ্যায় 'জননাঙ্গ' বা বিহারের মঙ্গলা গৌরীতে 'স্তন' পূজিত হওয়ার মাধ্যমে যে শারীরিক স্বাধীনতার বার্তা নিহিত, তাকে প্রতিষ্ঠা করে—জাত-ধর্ম নির্বিশেষে নারীদের পূজারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।

  • সম্পদের সমবণ্টন: মন্দির থেকে অর্জিত অর্থকে স্থানীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা।

শক্তিপীঠের বিপ্লবী চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, এই পুঁজিবাদী ধর্মব্যবস্থার শেকল ভাঙা আবশ্যক।

উপসংহার: মুক্তির জন্য শক্তিই আসল মন্ত্র

শক্তিপীঠ কেবল একটি ধর্মীয় ধারণা নয়; বামপন্থী দর্শনে এটি হলো মানবতাবাদী, নারীবাদী এবং শ্রেণিসংগ্রামী চেতনার প্রতীক। দেবী শক্তি এখানে ক্ষমতা বা ঐশ্বর্যের দেবী নন, তিনি হলেন পৃথিবীর বুকে নিপীড়িতের শক্তি, শোষকের বিরুদ্ধে বিপ্লবী ক্রোধ। সমাজের প্রতিটি স্তরের বৈষম্য, তা লিঙ্গগত হোক বা অর্থনৈতিক—তা দূর করতে হলে এই দেবী-চেতনাকে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। শক্তিপীঠের এই বিপ্লবী পাঠ আমাদের শেখায় যে, পরিবর্তন কেবল মন্দির বা উপাসনার মাধ্যমে নয়, তা আসে সংগঠিত মানুষের প্রতিরোধ ও সমতার আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে।

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies