কিন্তু বিধির লিখন ছিল অন্যরকম। মহারাজার অকাল প্রয়াণ এবং ব্রিটিশদের কুখ্যাত ‘Doctrine of Lapse’ নীতি, যা ঝাঁসিকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, রানীর শান্তিপূর্ণ জীবনকে এক রুদ্র রূপে বদলে দিল। ব্রিটিশদের ঔদ্ধত্য যখন ঝাঁসির স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইল, তখন লক্ষ্মীবাঈয়ের দৃঢ় কণ্ঠস্বর গর্জে উঠলো, "ম্যায় অপনি ঝাঁসি নাহি দুঙ্গি!" - "আমি আমার ঝাঁসি দেবো না!" এই কয়েকটি শব্দ ছিল কেবল একটি প্রতিজ্ঞা নয়, এটি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার এক জ্বলন্ত শপথ।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে রানী লক্ষ্মীবাঈ হয়ে উঠলেন এক আলোকবর্তিকা। তাঁর নেতৃত্বে ঝাঁসির দুর্গ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক অপ্রতিরোধ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিল। দুর্গের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করার জন্য তাঁরা মরণপণ লড়াই করল। সেই দৃশ্য কল্পনা করুন, যেখানে এক নারী, তাঁর পিঠে নিজ সন্তানকে বেঁধে, উন্মুক্ত তরবারি হাতে শত্রুর মোকাবেলা করছেন – এ শুধু সাহসিকতা নয়, এ এক মায়ের তাঁর মাতৃভূমি রক্ষার আবেগঘন লড়াই।
ঝাঁসির পতনের পর যখন সবকিছু শেষ মনে হচ্ছিল, রানী লক্ষ্মীবাঈ হার মানেননি। তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী, যিনি পরাজয়ের মাঝেও জয়ের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি তান্তিয়া টোপের মতো অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন। কালপি এবং গোয়ালিয়রের যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি সৈন্যদের মনে নতুন করে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলতো। তাঁর সামরিক কৌশল, তাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়তা – সবকিছুই ছিল ব্রিটিশদের জন্য এক চরম চ্যালেঞ্জ।
অবশেষে ১৮৫৮ সালের ১৮ই জুন, গোয়ালিয়রের যুদ্ধক্ষেত্রে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে, এই বীর রানী মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন। তাঁর মৃত্যু ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি, কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতের নারীশক্তির প্রতীক, স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানের চিরন্তন প্রেরণা।
আজও যখন আমরা ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের কথা স্মরণ করি, তখন আমাদের চোখে ভাসে তাঁর নির্ভীক মুখ, হাতে উদ্যত তলোয়ার আর দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা একটি নাম নন, তিনি প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়ে প্রোথিত এক অমর অনুভূতি – এক দেশপ্রেমের শিখা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রজ্বলিত থাকবে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কতটা জরুরি, এবং স্বাধীনতার মূল্য কতখানি। রানী লক্ষ্মীবাঈ অমর রহে!