বাগদাদ, ১২ নভেম্বর ২০২৫:
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচন ২০২৫-এর প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি'র নেতৃত্বাধীন 'রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোয়ালিশন' সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। তবে, ইরাকের রাজনৈতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে এবারও কোনো একক দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, যার ফলে আগামীতে সরকার গঠনের জন্য দীর্ঘ ও জটিল জোট-আলোচনা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ফলাফলের প্রধান দিক:
প্রধানমন্ত্রী সুদানি'র জোট প্রায় ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি ভোট পেয়ে ৪৬টি আসন নিশ্চিত করেছে। রাজধানী বাগদাদসহ নাজাফ এবং কারবালার মতো দক্ষিণাঞ্চলীয় শিয়া-প্রধান প্রদেশগুলিতে এই জোট ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে, যা তাদের সাফল্যের মূল কারণ।
নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া প্রাথমিক ফলাফল অনুসারে, প্রধান প্রধান দল ও জোটগুলির প্রাপ্ত আসন সংখ্যা নিম্নরূপ:
| রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোয়ালিশন (প্রধানমন্ত্রী সুদানি'র জোট) | ৪৬টি আসন |
| প্রোগ্রেস পার্টি | ২৮টি আসন |
| স্টেট অফ ল কোয়ালিশন | ২৭টি আসন |
| আল-সাদিকুন ব্লক | ২৭টি আসন |
| কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি | ২৬টি আসন |
| বদর অর্গানাইজেশন | ১৮টি আসন |
এই ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে, ইরাকের পার্লামেন্টে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রভাব এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী এবং কোনো একক গোষ্ঠী বা জোট সম্পূর্ণভাবে সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
ভোটার উপস্থিতি ও প্রেক্ষাপট:
এবারের নির্বাচনে প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ যোগ্য ভোটারের মধ্যে মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ (৫৬.১১%)। যদিও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়েছিল, তবুও এই মাঝারি স্তরের অংশগ্রহণ ইরাকের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থার প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচন ইরাকের জটিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি পরীক্ষা ছিল, ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়নি।
সরকার গঠনে জোটের বাধ্যবাধকতা:
যদিও প্রধানমন্ত্রী সুদানি'র জোট সবচেয়ে বড় একক ব্লক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তবুও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়, তাকে এখন সরকার গঠনের জন্য অন্য দলগুলির সঙ্গে জোট বাঁধতে হবে। ইরাকের সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন নিশ্চিত করার জন্য 'স্টেট অফ ল কোয়ালিশন', 'আল-সাদিকুন ব্লক' এবং কুর্দিস্তানের প্রধান দলগুলির সঙ্গে আলোচনা এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি এখন রাজনৈতিক মঞ্চের কেন্দ্রে থাকবে।
নির্বাচনের নেপথ্যের মূল বিষয়গুলি:
এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার পেছনে কয়েকটি গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় কাজ করেছে:
দুর্নীতি ও জন অসন্তোষ: দীর্ঘস্থায়ী দুর্নীতি, দুর্বল সরকারি পরিষেবা এবং ব্যাপক বেকারত্ব জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে। ভোটাররা আশা করেছিলেন যে নতুন সরকার এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি: ইরাকের ক্ষমতা ভাগাভাগির 'মুহাসাসা' পদ্ধতি (Muhasasa system) যা জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টন করে, তা এখনও ভোটারদের আচরণ এবং দলগুলির জোট গঠনে প্রধান প্রভাব ফেলেছে।
বাহ্যিক প্রভাব: ইরাক এখনও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের শিকার, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের প্রভাব অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পরিবর্তিত নির্বাচনী আইন: নতুন নির্বাচনী আইন এবং জেলা বিভাজন ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে, যা প্রতিষ্ঠিত ও বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাবকে আরও জোরদার করেছে।
ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণ:
উল্লেখযোগ্যভাবে, ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টি (Iraqi Communist Party) এবার 'কিয়াম' কাঠামোর অধীনে 'সিভিল ফোর্সেস কোয়ালিশন'-এর অংশ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এই জোটটি সব প্রদেশ মিলিয়ে প্রায় ১ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছে। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান দেখা গেছে দিওয়ানিয়া প্রদেশে, যেখানে তারা তৃতীয় স্থান অর্জন করে। তবে, সামগ্রিকভাবে, তাদের সমর্থন ছিল সীমিত ও স্থানীয়ভাবে কেন্দ্রীভূত।
মোটকথা, ২০২৫ সালের ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচন ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো বিশাল পরিবর্তন আনেনি, বরং প্রতিষ্ঠিত দলগুলির প্রভাবকে ধরে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী সুদানি'র জোটের বিজয় হলেও, আগামী সরকার গঠন হবে একাধিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পারস্পরিক বোঝাপড়া ও দর কষাকষির ফল।