ঢাকা: দেশের বন্দর, দেশের মাটি—তা বিদেশিদের হাতে তুলে না দেওয়ার দাবিতে স্লোগান তুলেছিল ওরা। গন্তব্য ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন ‘যমুনা’। কিন্তু সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হলো রাজপথ। দাবি ছিল জাতীয় স্বার্থ রক্ষার, কিন্তু বিনিময়ে জুটল নির্মম প্রহার।
আজ মঙ্গলবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর কাকরাইল মোড় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, বাংলাদেশ জাসদ এবং জাতীয় গণফ্রন্টের হাজারো নেতাকর্মী বুকে দেশপ্রেমের আগুন নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। তাঁদের একটাই দাবি—লালদিয়া ও পানগাঁও বন্দর টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে লিজ দেওয়া বাতিল করতে হবে এবং নিউমুরিং ও পতেঙ্গা টার্মিনাল লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া রুখে দিতে হবে।
সকাল সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে যখন মিছিলটি শুরু হয়, তখন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল “বন্দর লিজ মানি না, মানব না” স্লোগানে। কিন্তু মিছিলটি কাকরাইল মোড়ে পৌঁছাতেই পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। পুলিশ আগেই সতর্ক করেছিল, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকা ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ সভা-সমাবেশের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু আন্দোলনকারীরা যখন সেই বাধা ডিঙিয়ে সামনে এগোতে চাইলেন, তখনই শুরু হয় ধস্তাধস্তি।
মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বাম দলের শীর্ষ নেতাসহ বহু কর্মী। রক্তে ভিজে যায় অনেকের পোশাক। জানা গেছে, এই সংঘর্ষে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাঁদের আর্তনাদ আর পুলিশের বাঁশির শব্দে কাকরাইল এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনকারীদের ভাষায়, “আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা বলতে এসেছি। ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এপিএম টার্মিনালসের (APM Terminals) কাছে লালদিয়া টার্মিনাল তুলে দেওয়া মানে দেশের অর্থনীতির চাবিকাঠি বিদেশিদের হাতে সঁপে দেওয়া। এটি আধুনিকায়ন নয়, এটি গোলামির নতুন দলিলে স্বাক্ষর।” বাম নেতারা এই লিজ চুক্তিকে সরাসরি ‘দেশবিরোধী’ ও ‘জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কেবল নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশে বাধা দিয়েছে এবং মিছিলটি থামাতে লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়েছে, তবে সহিংসতা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।
লাঠিচার্জের পর ছত্রভঙ্গ না হয়ে আহত শরীর নিয়েই নেতাকর্মীরা কাকরাইল মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে তাঁরা স্লোগান দিতে দিতে আবার প্রেসক্লাবের দিকে ফিরে যান। তবে দমে যাননি তাঁরা। পুলিশের এই হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন বাম নেতারা।
আজকের এই ঘটনা আবারও প্রশ্ন তুলে দিল—জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নে জনগণের বা রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত প্রকাশের স্থান আসলে কতটুকু? দেশের সম্পদ রক্ষার দাবিতে নামা মানুষের রক্ত কি এভাবেই ঝরবে রাজপথে?





