নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা
১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছাত্রনেতা ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান (বিন) হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে হামলার চেষ্টার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
ছায়ানট ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রচর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ‘ছায়ানট’ ভবনে বৃহস্পতিবার রাত ১টা থেকে পৌনে ২টার মধ্যে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ও মোবাইল ফুটেজে দেখা যায়, হামলাকারীরা ধানমন্ডির ভবনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। ভিডিওতে একাধিক হামলাকারীর মুখমন্ডল উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। তারা ভবনের ভেতরের বাদ্যযন্ত্র, আসবাবপত্র ও মূল্যবান নথিপত্র ভাঙচুর করে এবং সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। সংস্কৃতি কর্মীরা এই ঘটনাকে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর পরিকল্পিত আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভিডিও ফুটেজে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।
গণমাধ্যমের ওপর চড়াও দুর্বৃত্তরা
একই রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ (The Daily Star) ও বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’ (Prothom Alo)-র প্রধান কার্যালয়েও ভয়াবহ হামলা চালানো হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা ভবনের নিচতলায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ভবনের ভেতরে ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক আটকা পড়েন, যাদের পরবর্তীতে নিরাপত্তা বাহিনী উদ্ধার করে। এই হামলার ফলে পত্রিকা দুটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা এই ঘটনাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা
সহিংসতার প্রভাব পড়েছে কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও। চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন (Assistant High Commission) ভবনের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং হামলার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সামনেও উগ্রবাদী স্লোগান ও মিছিল দেখা গেছে। ভারত সরকার অবিলম্বে তাদের মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনেও পুনরায় ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সরকারি পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়া
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার দেশজুড়ে ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করেছেন। তিনি সকলকে শান্ত থাকার এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, ভিডিও ফুটেজ ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং নেটিজেনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনাগুলোকে ‘সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের ওপর কাঠামোগত আক্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে দেশ দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারে।






