নয়াদিল্লি, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫: ২০১৭ সালের উন্নাও নাবালিকা ধর্ষণ মামলায় দণ্ডিত প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের স্বস্তিতে জল ঢেলে দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সোমবার এক জরুরি হস্তক্ষেপে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের সেই নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে, যাতে সেঙ্গারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড স্থগিত রেখে তাকে শর্তসাপেক্ষ জামিন দেওয়া হয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ও সিবিআই-এর আবেদন
ভারতের প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি জে কে মহেশ্বরী এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মসিহের সমন্বয়ে গঠিত তিন বিচারপতির একটি অবকাশকালীন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (CBI)-এর আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিতাদেশ দেন। সিবিআই গত ২৩ ডিসেম্বর দিল্লি হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল।
আদালত এই মামলার কিছু "অস্বাভাবিক তথ্য" (peculiar facts) উল্লেখ করে জানায় যে, সেঙ্গার শুধুমাত্র এই ধর্ষণ মামলাতেই নয়, বরং নির্যাতিতার বাবার হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় অন্য একটি পৃথক মামলায় ১০ বছরের সাজা ভোগ করছেন। আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছে, "দিল্লি হাইকোর্টের ২৩ ডিসেম্বরের নির্দেশের কার্যকারিতা স্থগিত করা হলো। ফলে ওই নির্দেশের ভিত্তিতে রেসপন্ডেন্ট (সেঙ্গার) মুক্তি পাবেন না।"
পাশাপাশি, আদালত সেঙ্গারকে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেওয়ার নোটিশ জারি করেছে। আগামী জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
আইনি বিতর্ক: বিধায়ক কি 'পাবলিক সার্ভেন্ট'?
সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্নও উত্থাপন করেছে। পকসো (POCSO) আইনের অধীনে একজন বিধায়ককে 'পাবলিক সার্ভেন্ট' বা জনসেবক হিসেবে গণ্য করা হবে কি না, দিল্লি হাইকোর্টের সেই ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। এই রায়ের প্রভাব ভবিষ্যতে একই ধরনের অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
মামলার প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘ লড়াই
২০১৭ সালের জুন মাসে উত্তরপ্রদেশের বাঙ্গারমউ কেন্দ্রের তৎকালীন প্রভাবশালী বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের বিরুদ্ধে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মামলা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ, ২০১৮ সালে নির্যাতিতার বাবার পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু এবং ২০১৯ সালে নির্যাতিতার ওপর হওয়া ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা—সব মিলিয়ে এই মামলাটি জাতীয় স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলাটি উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির একটি বিশেষ আদালত সেঙ্গারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে নির্যাতিতার বাবার মৃত্যুর ঘটনায় তাকে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় ও জনরোষ
গত ২৩ ডিসেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট সাত বছর জেল খাটার যুক্তিতে সেঙ্গারের সাজা স্থগিত রেখে তাকে ১৫ লক্ষ টাকার বন্ডে জামিন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এই নির্দেশ সামনে আসতেই দিল্লির যন্তর মন্তর ও সংসদের আশেপাশে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। মানবাধিকার কর্মী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করে। নির্যাতিতা ও তার পরিবারও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের আজকের এই স্থগিতাদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন নির্যাতিতা ও তার পরিবার। নির্যাতিতা বলেন, "ন্যায়বিচারের ওপর আমার বিশ্বাস পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো।" তার মা আবেগপ্রবণ হয়ে সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানান।
অন্যদিকে, কুলদীপ সিং সেঙ্গারের কন্যা ঐশ্বর্য সেঙ্গার আদালতের এই সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার দাবি, তাদের পরিবারও দীর্ঘ আট বছর ধরে বিচারের অপেক্ষা করছে।
সাত বছর আগে শুরু হওয়া এই আইনি লড়াই এখন এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে। জানুয়ারিতে পরবর্তী শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট কী সিদ্ধান্ত নেয়, এখন সেদিকেই তাকিয়ে সারা দেশ।


