বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা
আহমেদ তালাত তাহজীব
(সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)
গোটা ভারতজুড়ে অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিলো, সেটা চাপা পড়ে গেল নুপুর শর্মা কান্ডে।কৃষকদের বহু আন্দোলন বিজেপি নষ্ট করেছে হিন্দুত্ববাদীরা ধর্মীয় বিতর্ক সামনে এনে।ঠিক আওয়ামীলীগও একইভাবে শ্রমিকদের আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন বানচাল করে দেয় তার পোষা হেফাজতলীগ, চরমোনাই, ওলামালীগদের উটকো ধর্মীয় ইস্যুতে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে। অর্থপাচার, লুটপাট, দুর্নীতি কান্ডগুলো সামনে এলেই আওয়ামীলীগ এদের ব্যবহার করে ধর্মীয় ইস্যু সৃষ্টি করে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দেয়।
শেষপর্যন্ত উভয় দেশে শোষকশ্রেণী আর লুটেরা সরকার ছাড়া আর কারো কোন লাভ হয় না। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে যতগুলো পূজামণ্ডপে, মন্দিরে, হিন্দু ঘরবাড়িতে হামলা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতাকর্মী জড়িত ছিল তাই সেসব হামলার একটিরও সুবিচার হয়নি।
উভয় রাষ্ট্রে শোষকশ্রেণী ধর্মভিত্তিক সস্তা কৌশল ব্যবহার এইজন্যই করতে পারছে কারন উভয় রাষ্ট্রের জনগণ যুক্তিবুদ্ধি, সচেতনতা, সত্যতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয় ধর্মকে। অর্থাৎ জনগণ ঠকছে তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারনে কিন্তু তারপরও তাদের এই বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে নিজেদের মুক্ত করছে না তারা।
নিজের ধর্ষক, অপহরণকারী, নির্যাতকের প্রেমে পড়া একপ্রকার মানসিক ব্যাধি যাকে বলা হয় স্টকহোম সিন্ড্রোম। ধর্মের কারনে প্রতারিত, প্রবঞ্চিত, শোষিত ভারত ও বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণকে দেখে মনে হয় এরা গণস্টকহোম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। উন্নতি করতে গেলে আগে সুস্থ হতে হয় আর সুস্থ হতে হলে আগে অসুস্থতা নিরাময় করতে হয়, তাই অসুস্থতা নিয়ে একটা জাতি মুক্ত হতে পারে না আর উন্নতি করা তো পরের কথা।
এই ধর্মপ্রাণ জনগণের ধর্মান্ধতা এতটাই গভীরে যে চাইলেই এদের মুক্ত করা সম্ভব। সকল ধর্মে সবচেয়ে বেশি শোষিত ও বৈষম্যের শিকার নারীরা অথচ পারিবারিকভাবে দেখা যায় নারীদেরই সবচেয়ে বেশি ধর্মাশ্রয়ী হতে। এই সামান্য নমুনা থেকে বুঝা যায় যে ধর্মের শিকড় এতটাই গভীরে যে একে উপড়ানো সহজসাধ্য বিষয় না।
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি?-
আমরা যদি ইউরোপের ইতিহাস দেখি, সেখানে দেখতে পাই সমাজে ধর্মান্ধতা দূর করতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের প্রধান লক্ষ্য ব্যক্তিমুনাফা আর সেটা তার সম্ভব হয় শ্রমিকের শ্রমে। তাই শ্রমিক যতবেশী দক্ষ হবে উৎপাদন তত বাড়বে আর মালিকের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। তাই মুনাফার স্বার্থে ইউরোপের মালিকশ্রেণী দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার স্বার্থে সামাজিকভাবে ধর্মের প্রভাব খর্ব করে এবং বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধির সামাজিক সংস্কার করে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা পুঁজিবাদের গ্রামারে চলে না কারন তাদের মুনাফা প্রধানতই লুটপাট, কালোবাজারি ও দুর্নীতি নির্ভর সেই কারনে তার বিজ্ঞানমনস্ক দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। আর সেইকারনে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের শিক্ষা- পুঁজিবাদ লড়াই করবে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে, এটা বাংলাদেশে কার্যকর হয়নি। বরং কমিউনিস্টদের লড়তে হচ্ছে পুঁজিবাদের লড়াইটা।
কমিউনিস্টরা লড়াই যেটা করছে সেটা পর্যাপ্ত এবং কার্যকর হচ্ছে না তার প্রমাণ ধর্মভিত্তিক সামাজিক উগ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি। কমিউনিস্টরা প্রতিটা সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ করছে, ভুক্তভোগীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাহস দিচ্ছে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয় কারন রাষ্ট্রের শাসক আওয়ামীলীগ যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদের পৃষ্ঠপোষক।
কমিউনিস্টদের মূল করনীয় যেই শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণীভিত্তিক আন্দোলনের জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরকরণ সেটায় যেহেতু ঘাটতি আছে তাই সামাজিক প্রভাব কমিউনিস্টদের কম বলে শক্তিও কম এবং সেই কারনে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সামর্থ্যও কম। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা নৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও কমিউনিস্টদের মূল কাজ শ্রেণীসংগ্রাম চর্চায় বিচ্যুতির কারনে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারছে না।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তৃতীয় সূত্র- সংখ্যাগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন সাধিত করে।
তাই সূত্রানুযায়ী বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা তাদের শ্রেণীসংগ্রাম চর্চা যতবেশী বৃদ্ধি করবে সেটাই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে গুনগত পরিবর্তন সাধন করবে।


