ঠিকা-চুক্তি ভিত্তিক-অসংগঠিত শ্রমিকের নিয়ে গণ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হলো দুর্গাপুরের সিটিসেন্টারে।
বর্তমান সময়ে রাজ্য তথা দেশে এমনকি পৃথিবীর নানান উন্নত ও অনুন্নত দেশেও ঠিকা প্রথায় নিয়োগ ও চুক্তি ভিত্তিক কাজের মধ্য দিয়ে যথাসম্ভব কম মজুরিতে কাজ করিয়ে নেওয়া এবং শত শত বছরের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার হরণ করে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা উত্তরোত্তর থেকেই চলেছে। কাজের সময়, ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য বিধিবদ্ধ সুযোগ-সুবিধা, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা, বিবিধ সামাজিক সুরক্ষা সবই আজ ধান্দার ধনতন্ত্রের যুগে বিপরই শুধু নয়, এমনকি স্রেফ তুলে দেওয়া হচ্ছে।
প্রবল ক্ষমতাধর কর্পোরেট পুঁজি বিভিন্ন দেশের বশংবদ সরকারকে দিয়ে সেই মর্মে চালু আইন বাতিল করিয়ে নিজেদের সুবিধা ও ইচ্ছা অনুযায়ী নতুন আইন পর্যন্ত পাশ করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশের চারটি শ্রমকোড তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ফলে গোটা বিশ্ব জুড়েই শ্রমজীবী মানুষ, যারাই সমাজের সিংহভাগ, তারা এক মহা সফ টা আসলে কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের সীমাহীন বিকৃত লালসার ফলে সমগ্র সভ্যতাই এক অতলান্তিক অন্ধকারের মুখে। স্বাধীনতার পর দেশে স্বাক্ষর অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তোলা এবং দেশবাসীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্পায়নের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হিসাবে গড়ে উঠেছিল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে।
একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের পাশাপাশি প্রচুর অনুসারী শিল্প গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রগুলি প্রসারিত হতে থাকে। রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষের সমাগম হতে থাকে জীবিকার সন্ধানে। ক্রমে দুর্গাপুর কেবল শিল্পাঞ্চল হিসাবেই নয়, রাজ্য তথা সমগ্র পূর্ব ভারতেই অর্থনৈতিক মানচিত্রেও এক বিশিষ্ট স্থান অর্জন করে নেয়।
কিন্তু গত শতকের নয়ের দশকে তথাকথিত উদারনীতি ও আর্থিক সংস্কারের নামে এই প্রাণচঞ্চল শিল্পাঞ্চলেরও শ্বাসরোধের চিত্রনাট্য লেখা শুরু হয়। এই সর্বনাশা নীতি গতিপ্রাপ্ত হয় কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি সরকারের আমলে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় এম. এ. এম. সি. বি.এ.জি.এল., এইচ.এফ.সি. সহ জেলার আরও কিছু শিল্প এবং তার অনুসঙ্গে আরও অনেক ছোট মাঝারি উদ্যোগ ও পরিষেবা ক্ষেত্র। শিল্প নিবিড় এই জেলায় মানুষের রোজগার ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যাতে স্তব্ধ হয়ে না যায় সেই লক্ষ্যে রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সহযোগিতায় এবং এ.ডি.ডি.এ.-র উদ্যোগে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার পশ্চিমাঞ্চলে (বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলা) শতাধিক ছোট- মাঝারি লৌহ ইস্পাত কারখানা গড়ে ওঠে। এর জন্য বিদুৎ-জল-পরিবহন সহ নানান পরিকাঠামোও গড়ে তোলা হয়।
আবার ২০১১-য় রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে একদিকে যেমন মালিক ও কর্তৃপক্ষের কোনো রকম আইনকানুন না মানার প্রবণতা বেড়েছে, তেমনই শাসকদলের সীমাহীন তোলাবাজির কারণে বহু শিল্পে তালা ঝুলে গেছে। কেবলমাত্র দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেই বিভিন্ন কারখানা থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ঠিকা শ্রমিক ও অস্থায়ী কর্মীকে। রাজ্য সরকার ডি.পি.এল., ডি.সি.এল. এস. বি.এস.টি.সি.-র মৃত্যুঘন্টা বাজানোর পাশাপাশিই কেন্দ্রর সিদ্ধান্ত ডি.ভি.সি.-র ডি.টি.পি.এস. ইউনিট, জেলার অন্যতম শিল্প হিন্দুস্থান কেনিলস্ বন্ধ করার, এ.এস.পি. বিক্রি করার প্রভৃতি।
করোনা অভিমারি জনিত লকডাউনে এমনিতেই বহু মানুষ (সরকারি হিসাব গোটা দেশে ২০-২২ কোটি) কাজ হারিয়েছেন। যাদের কাজ কোনো রকমে টিকে গেছে তাদেরও একটা বড় অংশের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছাঁটাই হয়েছে। চাকুরীজীবি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দিয়েছে। সার্বিকভাবে এক নিরাশা ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে সমগ্র এলাকার মানুষকে।
তবে এই সর্বনাশের কারিগররা শেষ কথা বলবে তা তো হতে পারেনা।দুর্গাপুরের সিটিসেন্টারে গণ কনভেনশনে সি.আই.টি.ইউ. এর উদ্যোগে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বেলা ১১ টায় কলকাতার রানী রাসমনী রোডে রাজ্যের কেন্দ্রীয় সমাবেশ করার ডাক দেওয়া হয়। কনভেনশনকে সফল করার লক্ষ্যে এবং দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের অতীত ঐতিহ্য অনুসারে এক ব্যাপক শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে আজ দুর্গাপুর মহকুমার এই সমাবেশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতা বিনয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী।সমাবেশে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক নেতা বিস্বরূপ বন্দোপাধ্যায়, সিআইটিইউ এর কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ললিত মোহন মিশ্র , ঠিকা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা নিমাই ঘোষ।সমাবেশ থেকে জোরালো আওয়াজ ওঠে শ্রমিক-কর্মচারী স্বার্থ বিরোধী ৪ টি শ্রম কোড বাতিল করার দাবি সহ ন্যূনতম মজুরি ২৬,০০০ টাকা এবং স্থায়ী কাজে ঠিকা প্রথায় নয়, স্থায়ী হিসাবে নিয়োগ করতে হবে এবং স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরনের দাবি ।এছাড়াও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে উচ্ছেদ ও ছাঁটাই শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে পুনর্বহাল দাবি।









