নিজস্ব প্রতিনিধি, পানাগড়: পৌষের পড়ন্ত বিকেলে পানাগড় বাজারের চত্বরটা যেন আজ চেনা ছক ছাপিয়ে এক অন্য রূপ নিয়েছিল। রুক্ষ লাল মাটির দেশের ধুলো উড়িয়ে আজ সেখানে জমায়েত হয়েছিলেন তারা, যাদের হাতের আঙুলের ছাপে লেখা থাকে এদেশের অন্নের ইতিহাস। সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে আজ যেন এক মহামিলন মেলা বসেছিল— শোষণের বিরুদ্ধে সাহসের মেলা।
মঞ্চের ওপর যখন বক্তারা একের পর এক শোষণের কথা তুলে ধরছিলেন, নিচে বসা হাজার হাজার ক্লান্ত কিন্তু লড়াকু মানুষের চোখে ছিল আগামীর স্বপ্ন। কারো পরনে তালি মারা শাড়ি, কারো পায়ে শতচ্ছিন্ন চটি— কিন্তু প্রত্যেকের হাতে ধরা লাল ঝাণ্ডাটা ছিল এক অনন্য সম্মানের প্রতীক।
"আমরা ভিক্ষা চাই না, অধিকার চাই"
সমাবেশের প্রধান বক্তা, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক কমরেড মহম্মদ সেলিম যখন মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, গোটা পানাগড় বাজার তখন নিস্তব্ধ। সেলিম তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গর্জে উঠে বললেন,
"যারা দিনরাত রোদে পুড়ে আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়, আজ তারা কেন অবহেলিত? দিল্লির সরকার হোক বা রাজ্যের— খেতমজুরদের হকের টাকা কেন লুট হচ্ছে? এই লড়াই শুধু রুটিরুজির নয়, এই লড়াই আত্মসম্মানের।"
তিনি আরও বলেন যে, একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রেখে শ্রমিকদের পেটে লাথি মারছে কেন্দ্র, আর এ রাজ্যে দুর্নীতির পাহাড়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের নাম করে চলছে লুটপাট।
একজোট হওয়ার শপথ
কেন্দ্রীয় নেতা বিক্রম সিং তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার করে দেন যে, দেশের কৃষিব্যবস্থার মেরুদণ্ড হলো এই খেতমজুররা। অথচ নব্য উদারবাদী নীতি আজ তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। মঞ্চে উপস্থিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দও সাফ জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গ আজ দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে, আর তার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন গ্রামের ভূমিহীন মেহনতি মানুষ।
মানুষের কথা
সমাবেশের এক কোণে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন ষাটোর্ধ্ব লক্ষ্মী মুর্মু। চোখ ভিজে এসেছিল তার। ধরা গলায় বললেন, "কাজের টাকা পাই না কতদিন। ছেলেটা শহরে গেছে কাজ খুঁজতে। আমরা কি সারাজীবন এইভাবেই লড়াই করব?" আজকের এই সমাবেশ যেন সেই লক্ষ্মী মুর্মুদেরই জবাব। লাল নিশানার তলায় দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার খেতমজুর আজ শপথ নিলেন— "আর নয় চুপ থাকা, এবার হবে অধিকার বুঝে নেওয়ার পালা।" রাত নামার আগে যখন পানাগড় বাজার থেকে মিছিলগুলো আবার গ্রামের মেঠো পথের দিকে ফিরতে শুরু করল, তখন তাদের স্লোগান যেন বাতাসের কানে কানে বলে যাচ্ছিল— লড়াই শেষ হয়নি, লড়াই সবে শুরু হলো।





