ব্রিটিশ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ওরঙ্গজেবের প্রতিরোধ: এক ঐতিহাসিক অবস্থান
দেশজুড়ে ধর্মীয় বিভাজন তীব্র আকার ধারণ করলেও দেশপ্রেমের প্রতিযোগিতা আরও জোরদার হচ্ছে। এই সময়ে ইতিহাসকে নতুন করে বোঝার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এবং মুঘল সম্রাট ওরঙ্গজেবের ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। একদিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাকে একাধিক হিন্দু মন্দির ধ্বংসের জন্য অভিযুক্ত করেন, অন্যদিকে তার দেশপ্রেম ও ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা উঠে আসছে।১৬০০ শতকে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাতে প্রবেশ করে মশলার ব্যবসার জন্য কারখানা স্থাপনের অনুমতি চায়, তখন ওরঙ্গজেব তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দিহান হয়ে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
তখন গুজরাটে পর্তুগীজদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশরা কলকাতাকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের চেষ্টা করলেও ওরঙ্গজেব তাদের এই প্রস্তাবও খারিজ করেন।পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, জোসিয়া চাইল্ডের নেতৃত্বে, আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়। তারা মুঘল জাহাজ লুট করে, যার মধ্যে মুসলিম তীর্থযাত্রীদের বহনকারী জাহাজও ছিল। এর জবাবে ওরঙ্গজেব ১৬৮৬-১৬৯০ সালের অ্যাংলো-মুঘল যুদ্ধে, যা চাইল্ডস ওয়ার নামেও পরিচিত, কঠোর পদক্ষেপ নেন। তিনি কোম্পানির সব কারখানা বাজেয়াপ্ত করেন, তাদের কর্মীদের বন্দী করেন এবং সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মুঘল নৌবহর বোম্বেকে প্রায় এক বছর ধরে অবরোধ করে, যা দুর্ভিক্ষের কারণ হয় এবং কোম্পানিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
ওরঙ্গজেব এও দাবি করেন যে, ইংরেজ জলদস্যু হেনরি এভরিকে খুঁজে শাস্তি দেওয়া হোক, যার দল মুঘল জাহাজে হামলা করেছিল। তিনি আরও হুমকি দেন যে, ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশদের সমস্ত বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিল করা হবে। ১৭০২ সালে, তার বাহিনী, সুবেদার দাউদ খান পান্নির নেতৃত্বে, ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাস) তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ করে, কোম্পানিকে শান্তির জন্য আবেদন করতে বাধ্য করে।প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওরঙ্গজেবের দরবারে দূত পাঠায়, যারা তার সামনে নতজানু হয়ে প্রায় ১৫ লাখ রুপি জরিমানা প্রদান করে এবং ভবিষ্যতে ভালো আচরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপরই ওরঙ্গজেব অবরোধ তুলে নেন এবং তাদের বাণিজ্যের অনুমতি ফিরিয়ে দেন, যার ফলে কোম্পানি বোম্বে এবং পরে কলকাতায় তাদের উপস্থিতি ধরে রাখতে পারে।
ব্রিটিশদের এই প্রায় বিতাড়ন ছিল এক বিরল মুহূর্ত, যখন একজন ভারতীয় শাসক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরভাবে রুখে দেন, যা ওরঙ্গজেবের সফল দেশপ্রেমিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। তবে, তার উত্তরাধিকার জটিল। তিনি কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, যা প্রায়শই রাজনৈতিক বিদ্রোহ দমনের জন্য করা হয়েছিল, ধর্মীয় উগ্রতার কারণে নয়। তিনি কিছু মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তার এই কাজগুলো ধর্মীয় উগ্রতার চেয়ে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বেশি পরিচালিত হয়েছিল।ওরঙ্গজেবের সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তার ভূমিকাকে তুলে ধরে। তবুও, তার শাসনামলে ধর্মীয় বিভাজনের দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে, যা আধুনিক ভারতে দেশপ্রেম, ধর্ম এবং ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।