কঠোর পরিশ্রমের পর ন্যায্য পুরস্কার বা স্বীকৃতি সকলেরই কাম্য। এটি কর্মস্পৃহা বাড়ায় এবং শিল্পক্ষেত্রে একটি সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু কী হবে যখন পরিসংখ্যান দেখায় যে কর্মীরা আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন করছেন, অথচ তাদের পুরস্কারের পরিমাণ কমে যাচ্ছে?
ইস্পাত শিল্পের শ্রমিকরা ঠিক এমনই এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। উৎপাদন প্রতি বছর বাড়লেও, তাদের বোনাসের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই আপাত विरोधाभाসের পেছনের কারণ কী? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বোনাস আলোচনা সভা কেন ব্যর্থ হলো? এই পোস্টে আমরা সেই সভার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আশ্চর্যজনক দিক তুলে ধরব যা এই অচলাবস্থার আসল চিত্রটি স্পষ্ট করবে।
মূল বিষয় ১: বোনাসের এক অদ্ভুত ফর্মুলা
উৎপাদন বাড়লেও বোনাস কমছে কেন?
শ্রমিকদের অসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বোনাস নির্ধারণের একটি অদ্ভুত ফর্মুলা। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো, বিশেষ করে CITU এবং AITUC, পূর্বে যখন এই ফর্মুলাটি গৃহীত হয়েছিল, তখন থেকেই এটিকে 'পশ্চাদমুখী' (retrograde) আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করেছিল। এই 'পশ্চাদমুখী' ফর্মুলা সম্ভবত উৎপাদনের পরিবর্তে লাভ বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক মাপকাঠির উপর বেশি নির্ভরশীল, যার ফলে শ্রমিকদের সরাসরি প্রচেষ্টা এবং তাদের পুরস্কারের মধ্যেকার সংযোগটি ছিন্ন হয়ে গেছে।
তাদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে, এই ফর্মুলার কারণেই এক विचित्र পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বোনাসের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সময়কালে প্রতি বছরই কারখানায় উৎপাদন বেড়েছে। অর্থাৎ, শ্রমিকরা বেশি কাজ করেও কম বোনাস পাচ্ছেন, যা ফর্মুলাটির কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
মূল বিষয় ২: দাবি ও প্রস্তাবের মধ্যে বিশাল ব্যবধান
শ্রমিকদের দাবি আর ম্যানেজমেন্টের প্রস্তাব: আকাশ আর পাতাল তফাৎ
আলোচনার টেবিলে শ্রমিক এবং ম্যানেজমেন্টের প্রস্তাবের মধ্যে ব্যবধান ছিল বিশাল, যা অচলাবস্থার গভীরতাকে স্পষ্ট করে। শ্রমিক প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে ২০২২ সালে প্রাপ্ত বোনাসের পরিমাণ, অর্থাৎ ৪০,৫০০ টাকা দাবি করেন। তাদের যুক্তি ছিল স্পষ্ট: যেহেতু প্রতি বছর উৎপাদন বেড়েছে, তাই বোনাসের পরিমাণ কমার কোনো কারণ নেই, বরং তা অপরিবর্তিত থাকা উচিত।
এর বিপরীতে, ম্যানেজমেন্ট বিদ্যমান "পশ্চাদমুখী" ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করে মাত্র ২৯,৫০০ টাকা বোনাসের প্রাথমিক প্রস্তাব দেয়। এই দুটি সংখ্যার মধ্যে ১১,০০০ টাকার বিশাল পার্থক্য (অর্থাৎ, শ্রমিকদের দাবির প্রায় ২৭% কম) শুরুতেই আলোচনাকে একটি জটিলতার দিকে ঠেলে দেয়।
মূল বিষয় ৩: ব্যর্থ আপোসের চেষ্টা
ঐক্য রক্ষায় ছাড়, তবুও অনড় ম্যানেজমেন্ট
আলোচনা চলাকালীন অচলাবস্থা ভাঙতে একটি আপোসের চেষ্টা করা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে ৩২,৫০০ টাকার একটি মধ্যমপন্থী প্রস্তাব উঠে আসে। শ্রমিকদের স্বার্থে এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার জন্য, CITU এই প্রস্তাবে তাদের পূর্ণ সমর্থন না থাকলেও এর বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকে। তাদের লক্ষ্য ছিল আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা।
কিন্তু ম্যানেজমেন্ট তাদের কঠোর অবস্থানে অনড় থাকে। তারা শ্রমিক পক্ষ থেকে দেওয়া এই ছাড়কেও প্রত্যাখ্যান করে এবং ইঙ্গিত দেয় যে তারা প্রায় ৩১,০০০ টাকার কাছাকাছি একটি অঙ্কের বেশি দিতে রাজি নয়। ম্যানেজমেন্টের এই অনমনীয় মনোভাব আলোচনার পথকে আরও কঠিন করে তোলে। শ্রমিক পক্ষ ম্যানেজমেন্টের এই পদক্ষেপটিকে শুধু একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান নয়, বরং এটি তাদের বিতর্কিত ফর্মুলাকে প্রতিষ্ঠা করার এবং আলোচনার শর্তাবলী একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখছে।
মূল বিষয় ৪: বিষয়টি শুধু বোনাসের নয়
বোনাসের আড়ালে জমে থাকা অন্যান্য দাবি
বোনাসের এই অচলাবস্থা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর একটি প্রতীক। শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণেই বোনাসের বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে আরও বেশ কিছু অমীমাংসিত দাবি যা দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে আছে।
এই অমীমাংসিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অবিলম্বে NJCS (National Joint Committee for Steel Industry) সভা আহ্বান করা।
- ৩৯ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা।
- সমস্ত শ্রমিকের জন্য একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট মঞ্জুর করা।
- চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা।
ম্যানেজমেন্ট এই দাবিগুলো নিয়েও কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি, যা শ্রমিকদের আরও হতাশ করেছে।
মূল বিষয় ৫: আলোচনার টেবিল থেকে আন্দোলনের পথে
আলোচনা ব্যর্থ, পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
শেষ পর্যন্ত, কোনো রকম সমাধান ছাড়াই সভা শেষ হয়। ম্যানেজমেন্টের মনোভাবকে শ্রমিক প্রতিনিধিরা "ঔদ্ধত্যপূর্ণ" (arrogant) এবং "শ্রমিক-বিরোধী" (anti-worker) বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাদের অবদানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।
CITU তাদের বিবৃতিতে শ্রমিকদের হতাশা তুলে ধরে বলেছে:
How the workers and any union, worth its name, can withstand such arrogance, despite contributing their best to production performance
অর্থাৎ, শ্রমিকরা তাদের সেরাটা দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর পরেও ম্যানেজমেন্টের এই ঔদ্ধত্য কোনো ইউনিয়ন বা কর্মী কীভাবে সহ্য করবে?
আলোচনার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, CITU এখন তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সরাসরি আন্দোলনের পথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সমস্ত প্ল্যান্ট এবং প্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে আন্দোলন শুরু করার জন্য শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
উপসংহার
ইস্পাত শিল্পের এই অচলাবস্থা একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেয়—উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যখন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করার আন্তরিক প্রচেষ্টা এক পক্ষের অনমনীয় মনোভাবের কারণে ব্যর্থ হয়, তখন শিল্পক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য।
এখন প্রশ্ন হলো, যখন আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন শিল্পে শান্তি ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার ভবিষ্যৎ কী?