দুর্গাপুর: প্রতি বছর এই সময়টায় দুর্গাপুরের ফুটবলপ্রেমীদের মন এক ভিন্ন আবেগে ভরে ওঠে। এই আবেগের মূলে রয়েছে শহীদ ষড়ানন মুখার্জী ও শহীদ সুনীল আচার্য্য-এর স্মৃতিতে আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্ট। ৫৩ বছর ধরে এই টুর্নামেন্ট কেবল একটি খেলা নয়, এটি এখানকার মানুষের ভালোবাসার, সংহতির এবং এক দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। দীর্ঘ ৫৩ বছরের এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না। টুর্নামেন্ট কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সুখময় বোস আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, "এই টুর্নামেন্ট কোনো বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলে না। এখানকার স্থানীয় মানুষরা, ক্লাবগুলো, এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও ১০ টাকা, ২০ টাকা করে দিয়ে এই টুর্নামেন্টকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।" তিনি জানান, ১৯৭২ সালে শহীদ ষড়ানন মুখার্জী এবং শহীদ সুনীল আচার্য্য-এর আত্মত্যাগের স্মৃতিতে এই টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল। মাঝেমধ্যে নানা প্রতিকূলতার কারণে টুর্নামেন্ট বন্ধ থাকলেও, এখানকার মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেগের জোরে তা আবার শুরু হয়েছে।
এবারের টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচটি ছিল এক টানটান উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আমরা কজন বয়েজ ক্লাব এবং উখড়া পূজারী সংঘ। নির্ধারিত সময়ে কোনো দলই গোল করতে না পারায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ৪-১ গোলের ব্যবধানে জয়ী হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আমরা কজন বয়েজ ক্লাব।
টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রাক্তন মেয়র রথীন রায়, বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক সুখময় বোস সহ অন্যান্য অতিথিরা খেলার মাঠে এসে খেলোয়াড় ও দর্শকদের উৎসাহ দিয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে সালাউদ্দিন মিধ্যা (আমরা কজন বয়েজ ক্লাব)-কে দেওয়া হয়েছে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ এবং ফেয়ার প্লে ট্রফি পেয়েছে হিরোজ।
সুখময় বাবু জানান, প্রতি বছর টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই বিশাল অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করতে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ও সহযোগিতা সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। "আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এই টুর্নামেন্টকে আরও ১০০ বছর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ এই খেলাটি শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়, এটি শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার এক জীবন্ত প্রতীক," বলেন তিনি।
যেখানে কর্পোরেট স্পন্সরশিপের জাঁকজমক ছাড়া খেলাধুলা অচল, সেখানে এই টুর্নামেন্ট প্রমাণ করে যে, মানুষের ভালোবাসা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে কোনো ঐতিহ্যই হারিয়ে যায় না। দুর্গাপুরের এই ফুটবল মাঠটি তাই কেবল খেলার মাঠ নয়, এটি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে একতা ও ভালোবাসার মন্ত্র শেখায়।