১. সূচনা: ভয়ের ক্যাটালগ এবং ভূত বদল
ভূত চতুর্দশী! আহা, কী মনোরম প্রথা! চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের ভূত তাড়াও। কিন্তু সে তো সেকালের কথা। একালের ভূতগুলো বড্ড স্মার্ট, আর আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বড্ড সেকেলে। কার্ল মার্কসের সেই 'কমিউনিজমের ভূত' তো কবেই ডাল-ভাত ভুলে বার্গারে মন দিয়েছে, ওটা আর ভয় দেখায় না। এখন বাজারের নতুনতম, সবথেকে বেশি দামি ভূতটার নাম হলো—'প্রতিবাদের ভূত'!
আজ্ঞে হ্যাঁ, সাহেব। এই ভূতটাই এখন সবথেকে দামি ঘাম ঝরায় বিশ্বের সেই ১ শতাংশ মহারথীদের, যারা ৯৯ শতাংশের কলার চেপে ধরে আছে। ৯৯ শতাংশ যখনই 'হক'-এর নামে হাঁচতে শুরু করে, তখনই এই ভূতটা জেগে ওঠে। আর এই ভূতকে তাড়ানোর জন্য আমাদের সরকার বাহাদুররা যে 'চৌদ্দ শাক'-এর রেসিপি তৈরি করেছেন, শুনলে আপনার চক্ষু চড়কগাছ হবে।
২. নতুন চৌদ্দ শাক: রেসিপি ফাঁস!
প্রথাগত চৌদ্দ শাক খেয়ে রক্ত পরিষ্কার হতো, কিন্তু তাতে তো আর 'প্রতিবাদের রক্ত' বন্ধ হয় না! তাই, প্রথাকে 'আধুনিকীকরণ' করা হয়েছে। এখনকার মেনুতে কী কী আছে, দেখুন:
১. বিভাজন পাতা (Bivajon Pata): (উপকারিতা: জনসাধারণকে এমনভাবে বিভক্ত করে দেয় যে তারা ভূতকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে।)
২. নিরাপত্তা মশলা (Nirapotta Masala): (উপকারিতা: একটি অতিরিক্ত সৈন্য-বহর বা Z-plus ক্যাটাগরি দেখাও, ব্যস! ভূত ভাববে, এ বাবা, এ তো ভি.আই.পি ভূত!)
৩. চুপ-করা-চিংড়ি (Chup Kora Chingri): (উপকারিতা: এর প্রভাবে দেশের কণ্ঠস্বর এমনভাবে স্তব্ধ হয়ে যায় যে ভূত চতুর্দশীতে আর কিছু শোনার দরকার হয় না।)
৪. ডিজিটাল ঢাকনা (Digital Dhakna): (উপকারিতা: সামান্য সমালোচনা হলেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দাও। আলো নেই, তো ভূতের ভয় কিসের?)
৫. আর বাকি দশটা শাক হলো—কেবল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ফোটোশপ করা উন্নয়ন!
এসব খেয়েও ভূত যদি না যায়, তাহলে বুঝতে হবে—ভূতের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি! তাই সরকার তখন একে 'সংক্রমণ' বলে ঘোষণা করে এবং নিজেদের কাঁধে বন্দুক তুলে নেয়।
৩. রাজার পোশাকের দাম
আপনারা বেশ বলেছেন—"রাজা তোর কাপড় কোথায়?"। সত্যি বলতে কী, এই যুগে রাজা আর তাঁর পোশাক নিয়ে ভাবেন না, ভাবেন পোশাকের ব্র্যান্ডিং নিয়ে।
যদি প্রতিবাদের ভূত সত্যি সত্যিই জেগে ওঠে, তবে রাজার পোশাকের চেয়েও জরুরি হলো রাজার জৌলুস। রাজার আশেপাশে ভিড়ের বহর আর চামচাদের স্তুতিই তাঁর পোশাক। জনগণ পোশাক দেখছে না, দেখছে রাজার নিরাপত্তার বহর আর চোখ ধাঁধানো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। জনগণ তো আর বোকা নয়, তারা শুধু ভালো করে জানে যে, সত্য বললে পরের দিন তাদের চৌদ্দ শাকও জুটবে না। তাই তারা জানে, রাজাকে নগ্ন দেখার চেয়ে চোখ বন্ধ করে শিস দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
৪. পূজামণ্ডপ: দুর্গন্ধ দূর করার সুগন্ধি মেলা
আর আমাদের রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান! পূজামণ্ডপে যখন এক গলা কাদা মেখে নেতার প্রবেশ ঘটে, তখন দেবীরও উচিত জিজ্ঞেস করা, "বাবা, এত পাঁক কেন?"
কিন্তু মা তো আর প্রশ্ন করেন না। কারণ, তিনি জানেন—এটাই প্রথা। রাজনীতির নোংরা পাঁক এতটাই শক্তিশালী যে, পূজার সব সুগন্ধি, ধূপ-ধুনো, আর ফুলের গন্ধও তার কাছে হার মেনে যায়। তাই বুদ্ধিমান জনগণও দুর্গন্ধটাকে সয়ে নেয়। "শ্যামা মায়ের পুজোয় মেতে ওঠা" মানেই হলো—এক দিনের জন্য 'দুর্গন্ধ বিরোধী আন্দোলনে' যাওয়া স্থগিত রাখা। এটা কোনো পলায়নবাদ নয়, এটা হলো 'সাময়িক সন্তুষ্টি' নামক চুরান, যা খেলে দু-এক দিনের জন্য সব প্রতিবাদী ভূত শান্ত হয়ে যায়।
৫. সার্থক চতুর্দশী ও ভূতের উপাসনা
সুতরাং, এই 'ভূত চতুর্দশী' কাদের জন্য সার্থক হলো?
আমাদের জন্য নয়। সার্থক হলো তাদের জন্য, যারা এত কৌশল সত্ত্বেও এখনও রাত জেগে ঘুমোতে পারে না। যারা প্রতিবাদের ভূতকে ভয় পেয়ে বিভাজনের বিষ ছড়ায়, সামরিক বাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর দিনরাত 'ন্যায়' নামক একটি ফুলের খোঁজ করে, যা তাদের বাগানে কোনোদিন ফোটে না।
যতদিন শাসক ভয় পাবে, ততদিন এই ভূত চতুর্দশী সার্থক। কারণ, শাসক তার রাজত্বে প্রতিবাদকে শূন্যে নামিয়ে আনলেও, শূন্যের মধ্যেও একটা অদৃশ্য 'ভয়'-কে খুঁজে পায়। সেই ভয়টুকুই হলো বাংলার শেষ সম্বল।
আসলে, ভূত চতুর্দশীতে এখন ভূত তাড়ানো হয় না, ভূতের উপাসনা করা হয়। কারণ, ভয় যদি চলে যায়, তবে তো রাজার আর প্রয়োজন ফুরোবে! কী দরকার সেই রিস্ক নেওয়ার?