পশ্চিম বর্ধমান, ৩ ডিসেম্বর:পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চল পশ্চিম বর্ধমানে সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (CITU)-এর ১২তম জেলা সম্মেলন সম্প্রতি (নভেম্বর ১, ২০২৫ তারিখে) অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা জেলার শ্রমিক আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। খন্দরায় "কমঃ বাসুদেব আচারিয়া নগর"-এ আয়োজিত এই সম্মেলন "কমঃ বিবেক হোম চৌধুরী মঞ্চ" কে সামনে রেখে বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার এবং আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার উপর বিশেষ জোর দিয়েছে।
পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চলে একসময় যা ছিল প্রগতি ও কর্মসংস্থানের প্রতীক, আজ তা এক জটিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে দীর্ঘদিনের শিল্প ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদ যেমন এই জেলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড, তেমনই অন্যদিকে কারখানা বন্ধ হওয়া, শ্রমিকদের অধিকার হর্ব, এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত এখানকার শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। সিটু (CITU)-এর আসন্ন জেলা সম্মেলন এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনকে এক নতুন দিশা দিতে চাইছে, যেখানে "নতুন দিগন্ত" ও "নতুন নেতৃত্ব" বিকাশের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি: পশ্চিম বর্ধমানের বর্তমান প্রেক্ষাপট
১. শিল্প ও কর্মসংস্থানের ক্ষয়:
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পশ্চিম বর্ধমানের প্রায় ২৮.৮২ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩৯% কর্মজীবী। জেলার মূল শিল্পগুলি হলো কয়লা খনন (রানীগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র), ইস্পাত উৎপাদন (দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট, ইসকো), এবং ভারী প্রকৌশল। কিন্তু, গত এক দশকে এই শিল্পাঞ্চলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কারখানার গেটে তালা পড়েছে। গোমতি ইন্ডাস্ট্রিজ, সৃষ্টি সিমেন্ট লিমিটেডের মতো বড় কারখানাগুলি পরিবেশগত নিয়মের কারণে বন্ধ হয়েছে, যা হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। এছাড়াও, কাঁকসা শিল্পাঞ্চলের ছোট ও মাঝারি মাপের বহু ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেডও বেসরকারীকরণ এবং আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬,৬০০ কোম্পানি চলে গেছে বলে অভিযোগ, যার একটি বড় অংশ পশ্চিম বর্ধমানের মতো শিল্পপ্রধান জেলাগুলিতেই। এই closures শুধু বেকারত্বই বাড়ায়নি, বরং স্থানীয় অর্থনীতির উপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, বহু শহরকে "Ghost Town"-এর পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
২. শ্রমশক্তি ও তার বিভাজন:
জেলার শ্রমশক্তি শুধু শিল্প খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। কৃষিশ্রমিক, গৃহস্থালি শিল্পের শ্রমিক এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরাও এখানে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার (LFPR) তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও, মূল শ্রমিক (Main Workers) এবং প্রান্তিক শ্রমিকদের (Marginal Workers) মধ্যে একটি বিভাজন রয়েছে, যা কর্মসংস্থানের গুণগত মানের পার্থক্য নির্দেশ করে। অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা এবং ন্যায্য মজুরির অভাব প্রকট।
৩. ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভূমিকা ও রাজনৈতিক মেরুকরণ:
পশ্চিম বর্ধমান দীর্ঘকাল ধরেই শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ঘাঁটি। সিটু-এর মতো বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি এখানে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও একটি মেরুকরণ এসেছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস (TMC)-এর উত্থানের পর থেকে টিএমসি-পন্থী ইউনিয়নগুলি শিল্পাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
টিএমসি-এর প্রভাব:
অভিযোগ উঠেছে যে, টিএমসি-এর রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে অনেক সময় সিটু-এর মতো বামপন্থী ইউনিয়নের কর্মীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, এমনকি তাদের চাকরিচ্যুতিও ঘটানো হয়। বার্নপুর এবং সালানপুরে নিরাপত্তা কর্মীদের ছাঁটাইয়ের ঘটনায় টিএমসি-এর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। টিএমসি-পন্থী ইউনিয়নগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিক কল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করছে।