
পোর্ট লুইস, মরিশাস:
মরিশাসের ইতিহাসে ২ নভেম্বর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্মস্পর্শী দিন। ১৮৩৪ সালের (কোথাও কোথাও ১৮৩৫ উল্লেখ করা হয়) এই দিনে 'অ্যাটলাস' (Atlas) নামক জাহাজটি প্রথম ভারতীয় চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের দলটিকে নিয়ে মরিশাসের মাটিতে পদার্পণ করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছর এই দিনটিকে 'ভারতীয় আগমন দিবস' (Indian Arrival Day) বা 'আপ্রভাসী দিবস' (Aapravasi Divas) হিসেবে জাতীয় ছুটির মাধ্যমে পালন করা হয়।
দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর 'মহা পরীক্ষা'
এই আগমন ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের এক 'মহা পরীক্ষা' ('Great Experiment')-এর সূচনা। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর মরিশাসের মতো উপনিবেশগুলিতে চিনি বাগানে শ্রমিকের যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়, তা পূরণের জন্যই দাসশ্রমের বিকল্প হিসেবে এই চুক্তিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারত থেকে সস্তায় শ্রমিক আমদানি করে আখের বাগানের উৎপাদন অক্ষুণ্ণ রাখা।
আপ্রভাসী ঘাট: এক ঐতিহাসিক পদচিহ্ন
২ নভেম্বর 'অ্যাটলাস' জাহাজটি প্রথম যে ভারতীয় শ্রমিকদলটিকে নিয়ে আসে, তারা পোর্ট লুইসের ঐতিহাসিক 'আপ্রভাসী ঘাট' (Aapravasi Ghat) অভিবাসন ডিপোতে এসে পৌঁছান। এই ঘাটটিই ছিল ভারতীয় শ্রমিকদের জন্য এক নতুন জীবনের প্রবেশদ্বার। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন (পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি) ভারতীয় শ্রমিক ১৮৩৪ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে চুক্তির অধীনে মরিশাসে অভিবাসন করেন, এবং তাদের প্রথম প্রক্রিয়াকরণ হয়েছিল এই স্থানে। এই ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে ২০০৬ সালে আপ্রভাসী ঘাটকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কঠোর চুক্তি ও দুর্ভোগের জীবন
চুক্তিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থায় শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের জন্য কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকত। এই চুক্তির বিনিময়ে তাদের জাহাজ ভাড়া, নামমাত্র মজুরি এবং চুক্তির শেষে ভারতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। তবে বাস্তবে শ্রমিকদের জীবন ছিল চরম দুর্দশাগ্রস্ত। অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, স্বল্প মজুরি, এবং উপনিবেশিক মালিকদের দ্বারা ঘন ঘন দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হতে হতো তাদের। যদিও পরে ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে কিছু নিয়ম ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, তবুও এই প্রথা ১৯ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত শ্রমিকদের জন্য ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বয়ে এনেছিল।
'অ্যাটলাস' জাহাজের বিভীষিকাময় যাত্রা
'অ্যাটলাস'-এর সমুদ্রযাত্রা ছিল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় এই শ্রমিকদের অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে দিন কাটাতে হতো। তাদের জাহাজের ডেক বা পাটাতনের নিচে আলো-বাতাসহীন, ঠাসাঠাসি এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হতো। খাদ্য ও জলের সরবরাহ ছিল সামান্য ও রেশনের। এই দীর্ঘ যাত্রা কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত গড়াতে পারত।
যাত্রাপথে কলেরা, স্কার্ভির মতো রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ত, যার ফলে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হতো। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিত। এই যাত্রার মাধ্যমে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং ভবিষ্যতের চরম অনিশ্চয়তা তাদের মানসিক কষ্টের মূল কারণ ছিল।
জাহাজে শ্রমিকের দৈনিক রুটিন
'অ্যাটলাস'-সহ সেই সময়ের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বহনকারী জাহাজগুলিতে কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা হতো। শ্রমিকদের দৈনিক রুটিন ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত:
ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাদের রোল কল বা হাজিরা দিতে হতো।
শৌচকার্য ও পরিচ্ছন্নতা সীমিত পরিসরে সম্পন্ন করতে হতো।
দিনের নির্দিষ্ট সময়ে সামান্য ও রেশনের খাবার (যেমন: রুটি, নুন মাখানো মাংস ও জল) পরিবেশন করা হতো।
দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের ভিড় করা জায়গায় আটকে থাকতে হতো। মাঝে মাঝে জাহাজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা অন্যান্য ছোটখাটো কাজে তাদের ব্যবহার করা হতো।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো, তবে চিকিৎসা ছিল অপ্রতুল।
রাতে কঠোর পাহারার মধ্যে তাদের বদ্ধ করে রাখা হতো।
এই রুটিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এবং কোনও বিদ্রোহ বা পালানো ঠেকানোর জন্য।
জাতীয় ছুটি ও স্থায়ী উত্তরাধিকার
ভারতীয় শ্রমিকদের এই বিশাল অভিবাসন মরিশাসের জনতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কাঠামোকে আমূল বদলে দিয়েছে। তাদের কঠোর পরিশ্রম মরিশাসকে একটি সফল চিনি উৎপাদনকারী উপনিবেশে পরিণত করতে সাহায্য করেছিল। ইন্দো-মরিশিয়ান সম্প্রদায়ের এই বিশাল অবদানকে সম্মান জানাতেই ২ নভেম্বরকে 'ভারতীয় আগমন দিবস' বা 'আপ্রভাসী দিবস' হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।
প্রতি বছর এই দিনে মরিশাসে বিশেষ অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং আপ্রভাসী ঘাটে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে সেই প্রথম শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। এই দিনটি কেবল একটি অতীত ঘটনার স্মৃতিচারণ নয়, বরং মরিশাসের জাতীয় পরিচিতি ও বিশ্বব্যাপী ভারতীয় প্রবাসীদের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।