ভারতে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলির জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ঘোষণা করা একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু সম্প্রতি বিহারের নির্বাচন এই প্রথাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, জনকল্যাণের শেষ কোথায় আর ভোট কেনার শুরু কোথায়? এই প্রবন্ধে আমরা বিহারের সাম্প্রতিক নগদ টাকা বিতরণের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিকগুলো তুলে ধরব, যা ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে।
কল্পনাতীত অঙ্ক: ১৪,০০০ কোটি টাকার সরাসরি বিতরণ
মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা-র অধীনে বিহারের ১.৪ কোটি মহিলার প্রত্যেককে ১০,০০০ টাকা করে সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এর মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪,০০০ কোটি টাকা। এই ঘটনার তাৎপর্য বিশাল, কারণ এটি কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল না, বরং নির্বাচনের ঠিক আগেই আসল টাকা বিতরণ করা হয়েছিল।
কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের চেয়েও যা বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তা হল এই পদক্ষেপের সময়—যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একেবারে হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছে।
সময়ের প্রশ্ন: নির্বাচনী আচরণবিধি চলাকালীন এই পদক্ষেপ কেন?
সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হলো, এই বিপুল পরিমাণ টাকা বিতরণ করা হয়েছে যখন রাজ্যে আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি (Model Code of Conduct) বলবৎ ছিল। যদিও নির্বাচন কমিশন এটিকে একটি "চলমান প্রকল্প" (ongoing scheme) হিসাবে অনুমোদন দিয়েছে, যা আইনত বৈধ। কিন্তু এই ঘটনা নির্বাচনী স্বচ্ছতার মূল ভাবনা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে—আইনের অক্ষরিক প্রয়োগ কি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে?
কল্যাণ নাকি ঘুষ? রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্ক
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং বিশ্লেষকরা এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রশান্ত কিশোর এবং কংগ্রেস নেতারা এই প্রকল্পটিকে সরাসরি "রাষ্ট্র-সমর্থিত ঘুষ" (state-sponsored bribery) বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্যই, এই প্রকল্পের সমর্থকদের যুক্তি হল, নির্বাচনের আগে এই ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ঘোষণা বা বিতরণ ভারতে নতুন কিছু নয় এবং অন্যান্য দলগুলিও একই পথে হেঁটেছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে এই পদ্ধতিটিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:
"বেহায়া অনৈতিক"
তাঁর মতে, এই পদ্ধতি নির্বাচনী নৈতিকতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে।
শুধু অভিযোগ নয়, তথ্যও কথা বলছে
এই প্রকল্পের প্রভাব শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ নেই, ভোটের ফলাফলেও তার প্রতিফলন স্পষ্ট। এই টাকা বিতরণের পর মহিলা ভোটারদের মধ্যে ভোটদানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এনডিএ একটি বিশাল জয়লাভ করে। এই ঘটনাকে সমর্থন করে আন্তর্জাতিক গবেষণাও। ২০২৩ সালের বিশ্ব ব্যাংকের একটি বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন পিয়ার-রিভিউড গবেষণা দেখায় যে, এই ধরনের নগদ টাকা বিতরণের ফলে নিম্ন-আয়ের এলাকাগুলিতে শাসক দলের সমর্থন ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বিহারের এই ঘটনা একটি মৌলিক দ্বন্দ্বকে সামনে এনেছে। একদিকে যেমন সরাসরি নগদ টাকা বিতরণ বা ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (DBT) নাগরিকদের ক্ষমতায়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, তেমনই নির্বাচনের মুখে এর ব্যবহার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষমতা রাখে। প্রশ্নটি কেবল নির্বাচনী সমতার নয়, বরং গভীরতর: ভারতের গণতন্ত্র কি এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে যেখানে সরকারের কোষাগারই হয়ে উঠবে শাসক দলের সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচনী অস্ত্র?


