আজ ১৮ই নভেম্বর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই দিনটি এক মহান আত্মত্যাগী বিপ্লবীর জন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়—তিনি হলেন বটুকেশ্বর দত্ত (Batukeshwar Dutt), যিনি সহযোদ্ধাদের মধ্যে বি কে দত্ত বা মোহন নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯১০ সালের আজকের দিনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষের ওরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর নির্ভীক লড়াই এবং পরবর্তীকালে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার কাহিনি একাধারে গৌরব ও বেদনার।
শুরুর জীবন ও বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষা
বটুকেশ্বর দত্ত তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা কানপুরে সম্পন্ন করেন। এই সময়েই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কানপুরের পণ্ডিত পৃথ্বী নাথ হাই স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আর এক কিংবদন্তী বিপ্লবী, ভগৎ সিংয়ের। এই সাক্ষাতই দুই বিপ্লবীর মধ্যে এক গভীর, অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের জন্ম দেয়। এই বন্ধুত্ব শুধু ব্যক্তিগত ছিল না, ছিল দেশের স্বাধীনতার প্রতি তাঁদের যৌথ প্রতিশ্রুতির ভিত্তি।
শীঘ্রই বটুকেশ্বর দত্ত 'হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন' (HSRA)-এর একজন সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী আদর্শ তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলিতে ঐতিহাসিক প্রতিবাদ (৮ই এপ্রিল, ১৯২৯)
বটুকেশ্বর দত্তের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে ১৯২৯ সালের ৮ই এপ্রিল। ব্রিটিশ সরকার তখন 'পাবলিক সেফটি বিল' এবং 'ট্রেড ডিসপিউটস বিল'-এর মতো একাধিক দমনমূলক আইন কার্যকর করতে তৎপর ছিল। এই আইনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছিল।
এই অন্যায় ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে একযোগে বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সভাকক্ষে অহিংস প্রকৃতির দুটি বোমা নিক্ষেপ করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কোনো প্রাণহানি নয়, বরং অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের কানে প্রতিবাদের শব্দ পৌঁছে দেওয়া। বোমা নিক্ষেপের পর তাঁরা পালানোর চেষ্টা না করে "ইনকিলাব জিন্দাবাদ" ধ্বনি দিয়ে স্লোগান দেন এবং নিজেদের গ্রেফতারের জন্য অপেক্ষা করেন।
এই সাহসিকতার জন্য তাঁদের বিচার হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ব্রিটিশ সরকার তাঁদের কুখ্যাত 'কালাপানি' বা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে নির্বাসিত করে।
সেলুলার জেলের অনশন ধর্মঘট ও আত্মত্যাগ
সেলুলার জেলের অমানবিক পরিবেশে বন্দী থাকাকালীন বটুকেশ্বর দত্ত তাঁর সহকর্মী ভগৎ সিং এবং অন্যান্যদের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক অনশন ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, নিম্নমানের খাবার এবং সাধারণ অপরাধীদের তুলনায় খারাপ সুযোগ-সুবিধার প্রতিবাদে এই ধর্মঘট শুরু হয়েছিল, যা প্রায় ৬৩ দিন স্থায়ী হয়।
এই অনশন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং এর ফলে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের অধিকারের ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করতে বাধ্য হয়। বন্দীদশার মধ্যেও বিপ্লবী আদর্শকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বটুকেশ্বর দত্তের এই ভূমিকা ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক।
১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে তিনি মূল ভূখণ্ড ভারতে প্রত্যাবর্তিত হন এবং পরে মুক্তিও পান। তবে এরপরও তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৪২ সালের 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'-এ অংশ নেওয়ায় তাঁকে আরও চার বছরের জন্য জেলে যেতে হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বিস্মৃতি ও আর্থিক সংগ্রাম
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও, বটুকেশ্বর দত্তের জীবন সহজ হয়নি। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যে সম্মান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তাঁর প্রাপ্য ছিল, তা তিনি পাননি। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বিহারের পাটনায় স্থায়ী হন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করেন। তাঁকে পরিবহন ব্যবসা চালানো বা সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লেখার মতো কাজও করতে হয়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি চরম আর্থিক সংকটে ভুগেছেন।
দীর্ঘ রোগভোগের পর এই মহান বিপ্লবী ১৯৬৫ সালের ২০শে জুলাই তারিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাকতালীয়ভাবে, তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁকে যেন লাহোরে তাঁর প্রিয় বন্ধু ভগৎ সিংয়ের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।
বিপ্লবীর উত্তরাধিকার
যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ভগৎ সিং, রাজগুরু বা সুখদেবের মতো সহযোদ্ধাদের কীর্তির আড়ালে খানিকটা চাপা পড়ে গেছে, তবুও বটুকেশ্বর দত্তের আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য। তিনি আজও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক 'বিস্মৃত নায়ক' বা 'Unsung Hero' হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। তাঁর জীবন দেখিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুধু সম্মুখ সমরে নয়, বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনেও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার মধ্যেই নিহিত। বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত তাঁর সাহস, প্রতিবাদের ভাষা এবং দেশের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতির জন্য ভারতের ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন।