গত ২৬শে নভেম্বর সরকারের নতুন শ্রম কোড বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের যে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, তা ছিল হিমশৈলের চূড়া মাত্র। সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ)-এর ডাকে জেলা ও কারখানা স্তরে হাজার হাজার শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত এবং ক্ষুব্ধ অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে অসন্তোষের আগুন ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। অনেকেই ভেবেছিলেন এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু পর্দার আড়ালে যা ঘটছে তা অনেক বড় এবং সুসংগঠিত এক পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।
সিআইটিইউ-এর ডাকে শ্রমিকদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াকে এখন একটি সুনির্দিষ্ট, পর্যায়ক্রমিক এবং দেশব্যাপী প্রতিরোধের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা সিআইটিইউ-এর সেই কৌশলগত পরিকল্পনাটি বিশ্লেষণ করব, যা আগামী দিনে দেশের শিল্প অঙ্গনে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করতে চলেছে।
স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ থেকে সংগঠিত প্রতিরোধ
২৬শে নভেম্বরের প্রতিবাদ সিআইটিইউ-এর আহ্বানে শ্রমিকদের এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল, কিন্তু এখন সেই ক্ষোভকে একটি আনুষ্ঠানিক, ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। সিআইটিইউ সচিবালয় এই আন্দোলনকে আরও তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং শুধুমাত্র প্রতিবাদ নয়, একে 'প্রতিরোধ ও অবাধ্যতার' পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। এর মূল লক্ষ্য হলো বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে গঠিত "যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন প্ল্যাটফর্মে" ঐক্যমত্য তৈরি করে এই সংগ্রামকে তীব্রতর করা এবং প্রতিরোধমূলক জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য শ্রমিকদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত করা। অর্থাৎ, এখন আর কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, বরং পরিকল্পিত এবং সম্মিলিত আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে।
ডিসেম্বর মাসব্যাপী ত্রি-স্তরীয় আন্দোলন
এই পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডিসেম্বর মাস জুড়ে একটি তিন-সপ্তাহব্যাপী পর্যায়ক্রমিক অভিযান। প্রতিটি সপ্তাহের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আন্দোলনকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে।
- ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ: এই সপ্তাহটি মূলত অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির জন্য নিবেদিত। সমস্ত রাজ্য এবং ইউনিয়ন কমিটিগুলিকে বৈঠক করে ডিসেম্বরের আন্দোলন ও বিক্ষোভের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বৈঠকগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীকে বোঝানো হবে কেন একটি বহু-દિવસব্যাপী ধর্মঘট এবং জঙ্গি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
- ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ: এই পর্বটিকে একটি 'তথ্যযুদ্ধ' বলা যেতে পারে। সরকারের নতুন শ্রম কোডের সুবিধা সম্পর্কে যে "মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রচার" চালানো হচ্ছে, তার মোকাবিলায় একটি জোরালো প্রচার অভিযান শুরু হবে। সিআইটিইউ কেন্দ্র থেকে সমস্ত পূর্ববর্তী পুস্তিকা, লিফলেট ইত্যাদি সংকলন করে একটি বিস্তৃত প্রচার সামগ্রী পাঠানো হবে। শ্রমিকদের উপর এই কোডগুলির আসল প্রভাব কী হবে, সেই বিষয়ে তাদের সচেতন করাই হবে এই প্রচারের মূল উদ্দেশ্য।
- ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ: এই সপ্তাহে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। শ্রম দপ্তর, জেলা সদর বা জেলা কেন্দ্রগুলির সামনে জেলা পর্যায়ে ব্যাপক দিন-রাত ধরনা, গণ অনশন এবং অন্যান্য বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে, শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে সেক্টর-ভিত্তিক ধর্মঘট বা কর্মবিরতির পরিকল্পনাও করা হতে পারে।
চূড়ান্ত লক্ষ্য: দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট
ডিসেম্বরের এই সমস্ত কার্যকলাপ আসলে একটি অনেক বড় লক্ষ্যের প্রস্তুতি মাত্র। সিআইটিইউ-এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন প্ল্যাটফর্মে ঐক্যমত্য গড়ে তুলে ২০২৬ সালের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে একটি দেশব্যাপী "বহু-દિવસব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট" আয়োজন করা। এই দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য থেকে ইউনিয়নগুলির দৃঢ়সংকল্পের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা স্বল্পমেয়াদী প্রতিবাদে সন্তুষ্ট নয়, বরং সরকারের উপর চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করার জন্য একটি সর্বাত্মক ও সম্মিলিত ধর্মঘটের দিকে এগোচ্ছে।
মোর্চা সম্প্রসারণ: কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি
এই পরিকল্পনাটি শুধুমাত্র শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে, এই আন্দোলনে কৃষক, কৃষি শ্রমিক এবং "গণতান্ত্রিক মানুষের অন্যান্য অংশকে" জড়িত করার প্রচেষ্টা চালানো হবে। এটি একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ পদক্ষেপ, কারণ এর মাধ্যমে প্রতিরোধের ভিত্তি আরও প্রশস্ত হবে। এই কৌশল শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে, যা আন্দোলনকে শুধুমাত্র শহুরে বা শিল্পকেন্দ্রিক হওয়া থেকে রক্ষা করে। শিল্প শ্রমিকদের পাশাপাশি দেশের গ্রামীণ এবং কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেলে এই আন্দোলন একটি গণ-আন্দোলনের রূপ নিতে পারে, যা সরকারের উপর বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি করবে।
সংকল্পের প্রশ্ন
সুতরাং, যা দেখা যাচ্ছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল, ক্রমবর্ধমান এবং দেশব্যাপী শিল্প-বিদ্রোহের methodical পরিকল্পনা। একটি আহ্বানের প্রতি শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাকে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধের দিকে চালিত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, শ্রমিক সংগঠনগুলির এই স্তরের সংগঠিত প্রতিরোধ কি সরকারের নতুন শ্রম কোড বাস্তবায়নের পরিকল্পনাকে সত্যিই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? এই কৌশলগত পদক্ষেপ সরকারের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত শ্রমশক্তির এক মৌলিক পরীক্ষা, যার ফলাফল আগামী দিনের শিল্প সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।



