বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণা ডেস্ক: ৮ নভেম্বর, ২০২৫
মহাবিশ্বের বিশালতা পরিমাপের জন্য মানবজাতির নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং দূরবর্তী গ্রহ মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন—এই দুটি বিষয়ই বর্তমানে মহাকাশ গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের একক 'আলোকবর্ষ' মহাবিশ্বের অকল্পনীয় দূরত্বকে পরিমাপ করে, আর পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ এবং সেখান থেকে নিরাপদে ফিরে আসার প্রযুক্তির উন্নয়ন নির্ধারণ করছে মানবজাতির আন্তঃগ্রহ (interplanetary) ভবিষ্যৎ।
আলোকবর্ষ: মহাবিশ্বের সীমাহীনতার প্রতীক
মহাকাশে দূরত্ব এত বেশি যে কিলোমিটার বা মাইল এককে পরিমাপ করা অসম্ভব। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা 'আলোকবর্ষ' (Light-Year) এককটি ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড অনুযায়ী, এক আলোকবর্ষ হলো আলো এক বছরে শূন্যস্থানে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তার সমান।
এই দূরত্বটি ঠিক কত? এটি হলো ৯,৪৬,০৭,৩,০,৪৭,২,৫৮০.৮ কিলোমিটার, যা প্রায় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটারের (৯৪৬ হাজার কোটি কিমি) কাছাকাছি।
এই সংখ্যাটি এতটাই বিশাল যে কল্পনা করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো একটি নক্ষত্রের দূরত্ব ১০ আলোকবর্ষ হয়, তবে তার অর্থ হলো:
১০ আলোকবর্ষ=৯৪,৬০,৭৩,০৪,৭২,৫৮০.৮ কিলোমিটার
এই এককটি ব্যবহার করেই বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্যালাক্সি বা তার বাইরের নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলির মধ্যেকার দূরত্ব নির্ধারণ করেন। এক আলোকবর্ষের এই বিশাল পরিমাপই মনে করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্ব আমাদের কল্পনার চেয়েও কত বড়।
পৃথিবী থেকে মঙ্গলের পরিবর্তনশীল দূরত্ব এবং ভ্রমণের সময়
আলোকবর্ষের তুলনায় পৃথিবী ও মঙ্গলের দূরত্ব অনেক কম হলেও, আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের জন্য এটিও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবী উভয়েই সূর্যকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। ফলে তাদের মধ্যেকার দূরত্ব সর্বদা পরিবর্তিত হয়।
গড় দূরত্ব: গড়ে পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার বা ২২ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার।
সর্বনিম্ন দূরত্ব (Closest Approach): যখন গ্রহ দুটি একে অপরের সবচেয়ে কাছে আসে, যাকে 'অপোজিশন' বলা হয়, তখন দূরত্ব কমে দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি ৪৬ লাখ কিলোমিটারে। ২০০৩ সালে সবচেয়ে কাছে আসার রেকর্ড হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ কিলোমিটার।
সর্বোচ্চ দূরত্ব (Farthest): যখন গ্রহ দুটি সূর্যের বিপরীত দিকে থাকে, তখন দূরত্ব বেড়ে ৪০ কোটি ১০ লাখ কিলোমিটারও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এই পরিবর্তনশীল দূরত্বের কারণে মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিতে হয়, যাকে 'উৎক্ষেপণ উইন্ডো' (Launch Window) বলা হয়।
ভ্রমণের সময়কাল:
বর্তমানে প্রচলিত রকেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে সাধারণত ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগে। এই সময় মূলত জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং শক্তি-দক্ষ 'হোম্যান ট্রান্সফার অরবিট' (Hohmann transfer orbit) পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্ধারিত হয়, যাতে প্রায় ৯ মাস লাগে। নাসা-এর রোবটিক মিশনগুলিও গড়ে ৭ মাসের কাছাকাছি সময়ে মঙ্গলে পৌঁছায়। তবে, স্পেসএক্স-এর মতো আধুনিক মহাকাশ সংস্থাগুলি প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে এই সময়কে কমিয়ে মাত্র ৩ থেকে ৫ মাসে (৮০ থেকে ১৫০ দিন) নিয়ে আসার ambitious লক্ষ্য স্থির করেছে।
মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রযুক্তি: এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ
মঙ্গলে মানুষ পাঠানো যতটাই কঠিন, সেখান থেকে পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে আসা তার চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ এর জন্য মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম একটি রকেট তৈরি করতে হবে, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং মহাকাশের কঠিন পরিবেশ সহ্য করতে পারে।
নাসা-ইএসএ Mars Sample Return মিশন:
বর্তমানে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে মূলত নাসা (NASA) এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA)। তারা যৌথভাবে 'মার্স স্যাম্পল রিটার্ন' (Mars Sample Return) নামে একটি ঐতিহাসিক মিশনের পরিকল্পনা করছে। এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মঙ্গলের মাটি ও পাথরের নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসা।
এই জটিল মিশনে ব্যবহৃত হবে:
১. মার্স অ্যাসেন্ড ভেহিকেল (Mars Ascent Vehicle - MAV): এটিই সেই মূল রকেট, যা নমুনা ক্যাপসুল নিয়ে মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষেপণ করবে এবং মঙ্গলের কক্ষপথে স্থাপন করবে।
২. আর্থ রিটার্ন অরবিটার (Earth Return Orbiter): এই যানটি মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে নমুনা-সহ ক্যাপসুলটি সংগ্রহ করে সেটিকে পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে আনবে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই রোবটিক প্রত্যাবর্তনের প্রযুক্তি ২০৩০ সালের দশকের মধ্যেই সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
নাসা, ইএসএ এবং স্পেসএক্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলিই এই 'রিটার্ন' প্রযুক্তির অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছে। এই প্রযুক্তি কেবলমাত্র রোবটিক মিশনের জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যতে মানুষ যখন মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপন করে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে, তার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করবে। এক আলোকবর্ষের বিশাল দূরত্বকে জয় করার স্বপ্ন হয়তো বহু দূরের, কিন্তু মঙ্গল গ্রহকে জয় করার মাধ্যমে মানবজাতি আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের দিকে প্রথম বড় পদক্ষেপটি নিতে চলেছে।