(The Alleged Nexus between Delhi and Kolkata: Secret 'Blessings' and Polarization Politics Behind TMC's Bengal Success)
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে (বিশেষত ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন) তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) বিপুল রাজনৈতিক সাফল্য শুধু মাত্র জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মার ফল নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে এক গভীর রাজনৈতিক কৌশল—যার মূল ভিত্তি হল বামেদের প্রতিহত করার এক সর্বসম্মত প্রচেষ্টা এবং মেরুকরণের রাজনীতিকে জিইয়ে রাখা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিতর্কিত জল্পনা রয়েছে: রাজ্যের শাসক দল কি তবে দিল্লীর বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে এক গোপন 'আশীর্বাদ' বা কৌশলগত সমর্থন পাচ্ছে?
এই নিবন্ধে তৃণমূলের সাম্প্রতিক নির্বাচনী সাফল্যের কারণগুলির পাশাপাশি এই চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক আখ্যান এবং বাংলায় তৃণমূলের কথিত অপশাসনের দিকগুলিও খতিয়ে দেখা হল।
‘দিল্লির আশীর্বাদ’—রাজনৈতিক আখ্যানের মূল কথা
তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে প্রকাশ্যে তীব্র সংঘাত চললেও, রাজ্যের বিরোধী দলগুলি (বিশেষত বাম ও কংগ্রেস) বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে এই দুই দলের মধ্যে এক কৌশলগত বোঝাপড়া রয়েছে। এই আখ্যানের ভিত্তিগুলি হল:
১. বাম-কংগ্রেসকে প্রতিহত করা: সমালোচকদের দাবি, বাংলায় দীর্ঘদিনের বাম শাসনকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার ক্ষেত্রে তৃণমূলকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে বিজেপি। তাদের মতে, সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসকে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে দিতেই এই দুই দল এক প্রকার 'মিত্রতা' বজায় রেখেছে।
২. মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র করা: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিজেপি-টিএমসি উভয়ই চায় বাংলায় রাজনৈতিক লড়াই মূলত হিন্দু বনাম মুসলিম মেরুকরণের উপর ভিত্তি করে চলুক। এর ফলে বাম বা কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি নিজেদের জমি ফিরে পেতে ব্যর্থ হবে, এবং ভোট তাদের দুই শিবিরের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত থাকবে।
তৃণমূলের রাজনৈতিক সাফল্য (২০২৪) ও প্রধান কারণ
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৪২টি আসনের মধ্যে ২৯টি আসন জিতে এক বিরাট রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড অর্জন করে , যেখানে ২০১৯ সালের ২২টি আসন থেকে তাদের জয়যাত্রার এক শক্তিশালী সংহতনের প্রতিফলন ঘটে । তৃণমূলের এই সাফল্যের পিছনে যে কারণগুলি মুখ্য ছিল:
১. সংখ্যালঘু ভোটের সংহতন ও মেরুকরণের রাজনীতি
তৃণমূল সংখ্যালঘু (মূলত মুসলিম) ভোটব্যাঙ্ককে ধরে রাখতে এবং আরও সংহত করতে সফল হয় । বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) নিয়ে উদ্বেগ সংখ্যালঘু ভোটারদের বৃহত্তর সংখ্যায় টিএমসি-র দিকে চালিত করেছে, যা কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের একাধিক শক্ত ঘাঁটিতে পরাস্ত করতে সহায়ক হয়েছে ।
২. মহিলাদের ভোট ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্প
‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো মহিলাদের লক্ষ্য করে তৈরি কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি মাসিক নগদ সহায়তা প্রদান করে, যার ফলে মহিলাদের মধ্যে একটি সুসংহত এবং বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয় । এই এবং অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পগুলি মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করেছে ।
৩. বাঙালি উপ-জাতীয়তাবাদ
তৃণমূল সাফল্যের সঙ্গে বাঙালি উপ-জাতীয়তাবাদের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে, নিজেদেরকে স্থানীয় স্বার্থের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে এবং বিজেপি-কে "বহিরাগত" হিসেবে চিত্রিত করেছে । কেন্দ্রীয় তহবিল আটকে রাখা এবং রাজ্যে শক্তিশালী তৃণমূল স্তরের নেতৃত্বের অভাবের জন্য বিজেপি-কে দায়ী করার তৃণমূলের কৌশল ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলে ।
CAA থেকে SIR: দিল্লির ‘অক্সিজেন সরবরাহ’—টিএমসি-র মসৃণ শ্বাসপ্রশ্বাস
পর্যবেক্ষক মহলে বহু চর্চিত এই অভিযোগটির মূল কথা হল: আপাতদৃষ্টিতে কেন্দ্র বা বিজেপি-র যে সব নীতি তৃণমূলের জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করার কথা, বাস্তবে সেগুলিই তৃণমূলকে পরোক্ষভাবে সুবিধা দিয়ে রাজ্যে তাদের রাজনৈতিক জীবন (মসৃণ শ্বাসপ্রশ্বাস) নিশ্চিত করেছে। সমালোচকদের চোখে, CAA থেকে SIR পর্যন্ত একাধিক কেন্দ্রীয় উদ্যোগ হল তৃণমূলের জন্য 'দিল্লির অক্সিজেন সরবরাহ'-এর মতো।
১. CAA—মেরুকরণের প্রথম গ্যাস সিলিন্ডার:
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA)-এর প্রবর্তনই বাংলায় রাজনৈতিক মেরুকরণের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
কৌশলগত সুবিধা: আইনটি চালু হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট একচ্ছত্রভাবে তৃণমূলের দিকে ধাবিত হয়েছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই গভীর ভয়ের কারণেই তারা তৃণমূলের দুর্নীতি বা অপশাসনের দিকগুলি উপেক্ষা করে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরই ভরসা রেখেছে। এই পরিস্থিতি নিশ্চিত করেছে যে বাম বা কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি আর কখনওই তাদের পুরোনো জনভিত্তি ফিরে পাবে না।
২. SIR ও পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যু—অক্সিজেনের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ:
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (SIR) প্রক্রিয়াকে তৃণমূল অত্যন্ত সফলভাবে 'অঘোষিত NRC'-এর ভয় হিসেবে প্রচার করেছে।
ভয় ও ডিভিডেন্ড: এই কৌশল সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যেকার আতঙ্ককে জিইয়ে রেখেছে, যা তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, ভোট লুঠ বা নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অভিযোগগুলি থেকে ভোটারদের মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে।
পরিপূরক সুবিধা: বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণ বা হয়রানির ঘটনাকে তৃণমূল 'বাঙালি-বিরোধী' কাজ হিসেবে তুলে ধরেছে, যা রাজ্যের সাধারণ বাঙালি ভোটারদের মধ্যেও বিজেপি-র বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করে। এই দুটি ইস্যু একসাথে মিশে তৃণমূলকে এক শক্তিশালী আবেগী রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড এনে দিয়েছে।
সংক্ষেপে, এই কেন্দ্রীয় নীতিগুলি এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে লড়াইটি কেবল বিজেপি বনাম তৃণমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, এবং এই মেরুকরণের পরিবেশে তৃণমূল তার ঐতিহ্যগত ভোটব্যাঙ্ককে আরও নিশ্ছিদ্রভাবে সংহত করার সুযোগ পায়।
কৌশলগত শিফট: RSS-এর নরম সুর
বিজেপি-র আদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)-এর দিক থেকেও সাম্প্রতিককালে তৃণমূলের প্রতি অপেক্ষাকৃত নরম মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সমালোচকদের মতে, এটি এক বৃহত্তর কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত । আরএসএস এখন সরাসরি সংঘাতের পরিবর্তে তৃণমূল স্তরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। এই নরম সুরের লক্ষ্য হল মধ্যপন্থী ভোটারদের দূরে না সরিয়ে একটি বৃহত্তর ভিত্তি তৈরি করা, যা প্রকারান্তরে বিজেপি-কে রাজ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করবে ।
অপশাসন ও হতাশার চিত্র: তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ
এত বড় সাফল্য সত্ত্বেও, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক অভিযোগ রাজ্যের মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, বিশেষত শিক্ষিত যুব সমাজ, মহিলা এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের মধ্যে এই হতাশা তীব্র ।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও ভোট লুঠ: স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) নিয়োগ দুর্নীতিতে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন এবং সিনিয়র টিএমসি নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে । পাশাপাশি, পঞ্চায়েত ও অন্যান্য নির্বাচনে ‘ভোট লুঠ’, বুথ দখল এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের অভিযোগও রয়েছে ।
আইন-শৃঙ্খলা ও নারী নির্যাতন: রাজ্যে নারী নির্যাতন ও যৌন অপরাধের ক্রমবর্ধমান ঘটনা, যার মধ্যে কলকাতা ল' কলেজের মতো হাই-প্রোফাইল মামলাগুলিও রয়েছে, তৃণমূল সরকারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছে ।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা: শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে যুব সমাজের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তাদের আস্থা আরও কমিয়ে দিয়েছে।
উপসংহার
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাফল্য এক জটিল মিশ্রণের ফসল—কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা, সুসংগঠিত পরিচয় রাজনীতি, এবং বিরোধী দলের দুর্বলতা ও বিভাজন । তবে ‘দিল্লির আশীর্বাদ’-এর জল্পনা, বামেদের দুর্বলতা এবং মেরুকরণের রাজনীতির উপর নির্ভরতা তৃণমূলের উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিতর্কিত দিক। বিশেষত CAA ও SIR-কে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আতঙ্ক তৃণমূলের রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডের জন্য এক 'অক্সিজেন সরবরাহ' হিসেবে কাজ করেছে, যা তাদের অপশাসনের দিকগুলি সত্ত্বেও নির্বাচনী সাফল্যকে নিশ্চিত করে। এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হবে।