চারিদিকে যখন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কালো মেঘ আর পরাশক্তিদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের দামামা বাজছে, ঠিক তখনই নিঃশব্দে এক নতুন ইতিহাস গড়ে ফেলল চীন। বিশ্ব যখন ধুঁকছে, বেইজিং তখন এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা পুরনো সব হিসাব-নিকাশকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাজারো চাপ আর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে তুচ্ছ করে চীনের এই বিস্ময়কর উত্থান আজ অর্থনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। চলুন, এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনের ৪টি রোমাঞ্চকর এবং অবাক করা সত্য জেনে নেওয়া যাক।
১. ইতিহাসের পাতায় এক অবিশ্বাস্য মাইলফলক: ট্রিলিয়ন ডলারের বিজয়রথ
এটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি জাতির অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চীন বাণিজ্যের উদ্বৃত্তে (accumulated trade surplus) ‘এক ট্রিলিয়ন ডলারের’ জাদুকরী সীমা অতিক্রম করেছে। ২০২৫ সালের রিপোর্ট বলছে, নভেম্বরে দেশটির রপ্তানি বেড়েছে ৬%। এই বিশাল অঙ্কটি চিৎকার করে বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে—বিশ্ব বাণিজ্যের সিংহাসন কার দখলে! এটি কেবল অর্থনীতির খতিয়ান নয়, এটি চীনের বিশ্বজয়ের এক জ্বলন্ত দলিল।
২. আমেরিকার সমস্ত ছক ও কৌশল ব্যর্থ: বাধার মুখেও অদম্য চীন
সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং আবেগের জায়গাটি এখানেই—বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকা যখন চীনকে থামানোর জন্য শুল্কের বেড়াজাল আর বাণিজ্যের শিকল পরানোর চেষ্টা করল, চীন তখন প্রমাণ করল তারা কতটা অপ্রতিরোধ্য। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পণ্য বিক্রি ৩০% কমে যাওয়ার পরেও তাদের মোট রপ্তানি থেমে থাকেনি, বরং ৬% বেড়েছে! এটি যেন এক নীরব বিপ্লব। চীন বুঝিয়ে দিল, তাদের অর্থনীতির চাকা এখন আর আমেরিকার মর্জির ওপর চলে না। তারা সব শেকল ছিঁড়ে নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে।
৩. পুরনো সম্পর্কের বদলে নতুন দিগন্ত: গ্লোবাল সাউথের বুকে নতুন বন্ধুত্ব
যখন এক দরজা বন্ধ হয়, সাহসী জাতিরা তখন নতুন দশটি দরজা খুলে ফেলে। আমেরিকার বাজারে ধাক্কা খাওয়ার পর চীন হতাশ হয়নি, বরং তারা পরম মমতায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর (গ্লোবাল সাউথ) দিকে। এই নতুন বন্ধুত্ব কেবল বাণিজ্যের নয়, এটি এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। চীন প্রমাণ করেছে, পুরনো বন্ধুদের অবহেলা তাদের থামাতে পারে না, বরং নতুন বন্ধুদের নিয়ে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে জানে।
৪. ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থান: এক হার না মানা গল্প
প্রকৃতি যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তখনও কি অর্থনীতি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? চীন দেখিয়েছে—হ্যাঁ, পারে। সম্প্রতি এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় যখন হাজারো ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে, তখনও চীনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড টলানো যায়নি। হাজারো প্রতিকূলতা আর ঝড়ের মধ্যেও চীন তার বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে আগলে রেখেছে। বেইজিং এখন প্রতিজ্ঞা করেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে তারা নিজেদের ঘরের চাহিদাকেই অর্থনীতির মূল শক্তিতে রূপান্তর করবে—যা তাদের করে তুলবে আরও স্বনির্ভর, আরও শক্তিশালী।
আগামীর পৃথিবী কার?
চীনের এই ট্রিলিয়ন ডলারের রেকর্ড কেবল তাদের উৎপাদন ক্ষমতার জয় নয়, এটি এক হার না মানা মানসিকতা এবং সময়ের সাথে নিজেকে বদলে ফেলার এক মহাকাব্য। যে কৌশলে চীন নিজেকে গ্লোবাল সাউথের সাথে জড়িয়েছে এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মন্ত্র জপছে, তাতে একটি প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে—
বিশ্ব বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ কি তবে প্রাচ্যের হাতেই সমর্পিত হতে যাচ্ছে? এই পরিবর্তনের ঢেউ বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।