নিজস্ব প্রতিবেদন, দুর্গাপুর:
সময় বহমান, বদলে গেছে দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চলের সেই পরিচিত ছবি। কারখানার সেই আকাশচুম্বী চিমনি থেকে বের হওয়া ধোঁয়া কিংবা শিফট বদলের সেই পরিচিত সাইরেন আজ অনেকের কাছেই কেবল স্মৃতি। কিন্তু যে বন্ধুত্ব আর সহমর্মিতার বীজ বপন হয়েছিল কারখানার তপ্ত চুল্লির ধারে, তা আজও অমলিন। সেই অটুট বন্ধুত্বের টানেই দুর্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী দেশবন্ধু ভবনে আয়োজিত হলো এএসপি (ASP) কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের প্রাণের সংগঠন ‘সহমর্মী’-র ১৩তম প্রতিষ্ঠা দিবস।
এদিন অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে পা রাখতেই দেখা গেল এক আবেগঘন পরিবেশ। কর্মজীবনের ব্যস্ততা শেষে বার্ধক্যের এই বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে ‘সহমর্মী’ আজ আর কেবল একটি সংগঠন নয়, বরং কয়েকশ প্রবীণ মানুষের বেঁচে থাকার রসদ হয়ে উঠেছে।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও উদ্বোধনী পর্ব
অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয় মঙ্গলালোকের মধ্য দিয়ে। মঙ্গলদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সংগঠনের সুযোগ্য নেতৃত্ববৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি গোপাল ভট্টাচার্য, সম্পাদক কে কে পাল, সহ-সভাপতি এস আর দাস, সহকারী সম্পাদক গুরু প্রসাদ ব্যানার্জি এবং মেডিক্যাল সেক্রেটারি সিনহা। তাঁদের হাত ধরেই গত ১৩ বছর ধরে এই সংগঠনটি আর্তের সেবা এবং সদস্যদের পাশে থাকার ব্রত পালন করে আসছে।
চিকিৎসক সংবর্ধনা: সেবার এক অনন্য নজির
এবারের প্রতিষ্ঠা দিবসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল উপস্থিত চিকিৎসকদের সংবর্ধনা প্রদান। বার্ধক্যজনিত কারণে এই সংগঠনের সদস্যদের সুস্থ রাখতে যে সমস্ত চিকিৎসকরা নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ ও সেবা দিয়ে চলেছেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের উত্তরীয় ও স্মারক দিয়ে সম্মান জানানো হয়। মেডিক্যাল সেক্রেটারি সিনহা মহোদয় তাঁর বক্তব্যে সদস্যদের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
স্মৃতির পাতায় ধুলো ঝেড়ে...
বয়সের ভারে কারোর শরীর কিছুটা ন্যুব্জ, কারোর দৃষ্টিতে চশমার পুরু কাঁচ, আবার কারোর চুলে ধরেছে রূপালি পাক—কিন্তু পুরনো সহকর্মীদের কাছে পেয়ে প্রত্যেকেই যেন সেই তরুণ বয়সের উদ্যমে ফিরে গিয়েছিলেন। কারখানার ক্যান্টিনের আড্ডা থেকে শুরু করে কঠিন কাজের চাপের মাঝে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর গল্পগুলো এদিন দেশবন্ধু ভবনের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
সংগঠনের সম্পাদক কে কে পাল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমরা যখন কাজে ছিলাম, তখন ছিলাম সহকর্মী। কিন্তু অবসরের পর আজ আমরা একে অপরের সহমর্মী। একাকীত্বের অন্ধকারে কেউ যাতে হারিয়ে না যান, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এই পথচলা।"
সাংস্কৃতিক ছোঁয়া ও সমাপ্তি
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুরনো দিনের গান আর কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁরা ফুটিয়ে তোলেন জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। সবশেষে এক প্রীতিভোজের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
১৩ বছর পেরিয়ে ১৪ বছরে পদার্পণ করা এই সংগঠনটি আবারও প্রমাণ করল যে, বয়স কেবল একটি সংখ্যা মাত্র; মনের মিল আর একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতাকে জয় করে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসকেও আনন্দময় করে তোলা সম্ভব।













