দুর্গাপুর, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫: দুর্গাপুরের ইস্পাত নগরীর বি.টি. রণদিভের (BTR bhavan) ছবিতে মালা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই শ্রদ্ধার্ঘ্যে আবেগের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতাই ছিল বেশি। আজ, এই অবিসংবাদী শ্রমিক নেতার ১২১তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে একটা রূঢ় সত্য প্রকট হয়ে উঠল—যে শ্রমিক শ্রেণির জন্য বিটিআর তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই শ্রেণিই আজ তাঁকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছে।
যাঁর শ্রমে আজকের ‘অধিকার’
আজ সকালে ডিএসপি (DSP)-র গেট দিয়ে যে তরুণ কর্মীটি কারখানায় ঢুকলেন, তাঁর কাছে হয়তো ‘বিটিআর’ শুধুই একটি নাম। কিন্তু তিনি জানেন না, মাস শেষে তিনি যে সম্মানজনক বেতনের স্লিপটি হাতে পান, তার নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই মানুষটি।
ভারতের ইস্পাত শ্রমিকদের এক ছাতার তলায় আনার জন্য ‘Steel Workers Federation of India’ (SWFI) গঠনের মূল মস্তিষ্ক ছিলেন বিটিআর। দুর্গাপুর থেকে ভিলাই—সব কারখানার শ্রমিকরা যাতে এক টেবিলে বসে মজুরি ঠিক করতে পারেন, সেই এনজেসিএস (NJCS) ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তরও তাঁরই হাতে গড়া। আজ শ্রমিকরা এরিয়ার্স বা বোনাস নিয়ে উল্লাস করেন, কিন্তু সেই অধিকার অর্জনের ইতিহাস মনে রাখেননি।
কেন এই বিস্মৃতি?
ইস্পাত নগরীর অলিগলিতে কান পাতলে এই বিস্মৃতির কারণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
১. শ্রেণি উত্তরণ: বিটিআর-এর আন্দোলনের ফলে যে স্থায়ী শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন, তাঁরা আজ আক্ষরিক অর্থেই মধ্যবিত্ত। তাঁদের লড়াই আজ আর রুটি-রুজির নয়, বরং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের। ইউনিয়ন অফিসের সেই পুরনো রাজনৈতিক ক্লাস আজ আর হয় না, তার জায়গা নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিচ্ছিন্ন জগত।
২. ঠিকা শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নতা: কারখানার আসল চাকাটা আজ ঘোরাচ্ছেন হাজার হাজার ঠিকা শ্রমিক। তাঁরা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন, কিন্তু আন্দোলনের ইতিহাস জানার সুযোগ বা সময়—কোনোটাই তাঁদের নেই। বিটিআর যে ‘স্থায়ী চাকরির’ লড়াই লড়েছিলেন, আজকের ঠিকা শ্রমিকরা সেই অধিকার থেকে যোজন দূরে।
ভুললে চলবে না
আক্ষেপের সুরে এক প্রবীণ নেতা বললেন, "আমরা শ্রমিকদের বোনাসের অঙ্ক কষতে শিখিয়েছি, কিন্তু সেই বোনাস আদায়ের জন্য যে রক্তঝরা ইতিহাস, তা শেখাতে পারিনি।"
বিটিআর-এর জন্মদিনে ইস্পাত নগরী শুধু একজন নেতাকে ভোলেনি, ভুলেছে নিজেদের শেকড়কেও। কারখানার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিবাদের সেই পুরনো আগুন আজ যেন ইস্পাত নগরীর শীতের রাতে নিভে আসছে।


