প্যারিস, ৯ ডিসেম্বর: প্যারিসের রাজপথে তখন হাড়কাঁপানো শীত, কিন্তু ফ্রান্সের জাতীয় সংসদের ভেতরে গনগনে উত্তাপ। সেই উত্তাপ সাধারণ মানুষের মুক্তির নয়, বরং এক চরম বিশ্বাসভঙ্গের। গত ৯ ডিসেম্বর, রাজনৈতিক নাটকীয়তা আর প্রতিবাদের ঝড় উপেক্ষা করে পাস হয়ে গেল ২০২৬ সালের সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট। কিন্তু এই বাজেট পাসের চড়া মূল্য চোকাতে হলো দেশটির বামপন্থী ঐক্যকে; যা এখন কার্যত চুরমার।
বারুদের স্তূপ বনাম মানুষের ক্ষুধা
বামপন্থী দলগুলোর (LFI, PCF, গ্রিনস) কাছে এই বাজেট কেবল কিছু সংখ্যার হিসাব নয়, এ যেন শ্রমজীবী মানুষের গালে এক চড়। সরকারের অগ্রাধিকার আজ স্পষ্ট—মানুষের পেটের ভাতের চেয়ে সীমান্তের বারুদ বেশি দামি।
বাজেটে সামরিক খাতে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ বিলিয়ন ইউরো। অথচ, যখন উগ্র বামপন্থীরা অতি-ধনীদের ওপর ‘জুকম্যান ট্যাক্স’ (সম্পদ কর) বসিয়ে সাধারণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি তুলল, সরকার তখন কানে তুলো দিল। রাষ্ট্রের বার্তা পরিষ্কার: যুদ্ধবিমান কেনার টাকা আছে, কিন্তু শ্রমিকের চিকিৎসার টাকা নেই। কৃচ্ছ্রসাধনের (Austerity) নামে সাধারণ মানুষের কাঁধেই আবারও চাপানো হলো ঋণের বোঝা।
ঘরের ভেতরেই শত্রু? বাম ঐক্যে ফাটল
সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটা ঘটল বিরোধী শিবিরের ভেতরেই। যে ‘নিউ পপুলার ফ্রন্ট’ (NFP) হওয়ার কথা ছিল মেহনতি মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, স্বার্থের দ্বন্দ্বে তা আজ খণ্ড-বিখণ্ড।
সরকার পতনের হুমকি দিয়ে যখন লঁ ফ্রান্স ইনসুমিজ (LFI) এবং কমিউনিস্টরা রাজপথ কাঁপাচ্ছে, ঠিক তখনই সমাজতন্ত্রীরা (Socialists) সরকারের সাথে হাত মেলাল। মাত্র কয়েক বছরের জন্য পেনশন সংস্কার স্থগিত রাখার ‘মরিচীকা’ দেখিয়ে সরকার সমাজতন্ত্রীদের বাগে আনল।
এলএফআই-এর নেত্রী ম্যাথিল্ড প্যানোটের কণ্ঠে তাই ঝরল তীব্র ঘৃণা ও অভিমান, “আজ যারা সরকারের এই জনবিরোধী বাজেটকে সমর্থন দিল, তারা ম্যাক্রোঁকে বাঁচাল, কিন্তু জনগণকে ডোবাল।” উগ্র বামপন্থীদের চোখে, এটি কেবল রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা।
এক অনিশ্চিত গোধূলি
বাজেট হয়তো পাস হয়েছে, কিন্তু ফ্রান্সের গণতন্ত্র কি জিতল? সংসদের অধিবেশন যখন শেষ হলো, বামপন্থী বেঞ্চগুলো তখন জনশূন্য, প্রতিবাদে বয়কট করা আসনগুলো যেন হাহাকার করছে। ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং বাম ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে সরকার হয়তো সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, কিন্তু প্যারিসের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ আর সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
উগ্র বামপন্থীদের হুঁশিয়ারি—এ লড়াই শেষ হয়নি। রাজপথের ফয়সালা এখনো বাকি। ২০২৬ সালের এই বাজেট ফ্রান্সের ইতিহাসে হয়তো ‘কালো অধ্যায়’ হয়েই লেখা থাকবে, যেখানে জনস্বার্থকে বলি দেওয়া হয়েছে ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে।


