প্রতিবেদন ডেস্ক | ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
তেল আবিব/ওয়াশিংটন ডি.সি.
২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে ইসরায়েল বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার এবং সোমালিল্যান্ড কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই "পারস্পরিক ঘোষণা" (Mutual Declaration) কেবল আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে নয়, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক সমুদ্র-রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপটি যেমন কৌশলগত সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে, তেমনি এটি ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের দীর্ঘদিনের অভিন্ন পররাষ্ট্রনীতিতে এক স্পষ্ট ফাটল ধরিয়েছে।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও কূটনৈতিক বিবর্তন
সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সালে সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও গত তিন দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি "অস্বীকৃত রাষ্ট্র" হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। যদিও তাদের একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামো, নিজস্ব মুদ্রা এবং সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী রয়েছে।
ইসরায়েলের সাথে সোমালিল্যান্ডের সম্পর্কের শেকড় ১৯৬০ সালের সংক্ষিপ্ত স্বাধীনতা লাভের সময়ের। দীর্ঘ কয়েক বছরের গোপন আলোচনার পর, যা মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যস্থতায় এবং 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস'-এর ধারাবাহিকতায় অগ্রসর হয়েছে, ইসরায়েল এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নেয়। সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট এই অংশীদারিত্বকে একটি "ঐতিহাসিক মাইলফলক" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২. ইসরায়েলের কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করছে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী তিনটি প্রধান লক্ষ্য:
লোহিত সাগরের নিরাপত্তা (Red Sea Hegemony): ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ক্রমাগত ড্রোন ও মিসাইল হামলার মুখে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচল হুমকির মুখে পড়েছে। সোমালিল্যান্ডের বারবেরা (Berbera) বন্দর ও তার উপকূলীয় অবস্থান ইসরায়েলি নৌবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের জন্য একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (Forward Operating Base) হিসেবে কাজ করবে।
ইরানি প্রভাব বলয় ছিন্ন করা: এডেন উপসাগরে ইসরায়েলের উপস্থিতি ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একটি নতুন ফ্রন্ট উন্মোচন করল।
আর্থ-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত সম্প্রসারণ: কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, জল ব্যবস্থাপনা এবং সাইবার নিরাপত্তায় সহযোগিতার মাধ্যমে ইসরায়েল আফ্রিকার এই কৌশলগত অঞ্চলে তার 'সফট পাওয়ার' প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।
৩. ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপোড়েন
ইসরায়েলের এই একতরফা পদক্ষেপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সাথে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনই সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা করছে না।
ভিন্ন অগ্রাধিকার: ট্রাম্প প্রশাসন বর্তমানে গাজা পুনর্গঠন এবং ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। সোমালিল্যান্ডের বিষয়টি তাদের কাছে আপাতত একটি "আঞ্চলিক বিক্ষেপ" (Distraction) হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
সোমালিয়ার অখণ্ডতা: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দীর্ঘকাল ধরে "এক সোমালিয়া" নীতি অনুসরণ করে আসছে। সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিলে পুরো আফ্রিকা মহাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উসকে যাওয়ার আশঙ্কা করছে ওয়াশিংটন।
ট্রাম্পের অবস্থান: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সোমালিল্যান্ডের প্রস্তাবিত বন্দর সুবিধার গুরুত্ব স্বীকার করলেও একে এখনই অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে রাজি নন।
৪. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই স্বীকৃতির ফলে একটি বিশাল কূটনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে:
| পক্ষ | অবস্থান | কারণ |
| সোমালিয়া | তীব্র নিন্দা | সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং অখণ্ডতা বিনষ্টের চেষ্টা। |
| তুরস্ক ও মিশর | প্রতিবাদ | লোহিত সাগরে ইসরায়েলি আধিপত্য বৃদ্ধি এবং নীল নদ কেন্দ্রিক আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের ভয়। |
| আফ্রিকান ইউনিয়ন | উদ্বেগ | মহাদেশীয় সীমানা পরিবর্তনের ঝুঁকি। |
| ফিলিস্তিন | নিন্দা | একে ইসরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। |
৫. ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ লোহিত সাগরের রাজনীতিকে আমূল বদলে দিতে পারে। যদি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো ইসরায়েলকে অনুসরণ করে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়, তবে সোমালিয়া একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল এই অঞ্চলে কতটুকু দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান তৈরি করতে পারবে, তা নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
পরিশেষে, সোমালিল্যান্ডকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, তেল আবিব এখন তার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওয়াশিংটনের সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা না করে একটি "স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি" (Independent Foreign Policy) গ্রহণে প্রস্তুত।


