বিশেষ প্রতিবেদন: মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি আইন—সংক্ষেপে যা 'মনরেগা' বা ১০০ দিনের কাজ নামে পরিচিত—দশকের পর দশক ধরে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি নিছক কোনও সরকারি প্রকল্প ছিল না; এটি ছিল অনাহার আর অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে গরিব মানুষের সাংবিধানিক কবচ। কিন্তু আজ সেই কবচ খসে পড়ার উপক্রম। অলক্ষ্যে, নিঃশব্দে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মেঘ ঘনিয়ে আসছে গ্রামীণ ভারতের আকাশে। একটি নতুন প্রকল্পের আড়ালে কি আসলে গরিবের 'অধিকার' কেড়ে নিয়ে তাকে সরকারি দয়ার পাত্রে পরিণত করা হচ্ছে? আমাদের অনুসন্ধানে উঠে এল এক ভয়াবহ ব্লু-প্রিন্ট।
‘ব্যর্থতার স্মারক’ থেকে কফিনের শেষ পেরেক
২০১৪ সাল। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, তিনি মনরেগা বন্ধ করবেন না। কেন? কারণ তিনি চেয়েছিলেন এই প্রকল্পটিকে কংগ্রেস সরকারের "ব্যর্থতার জীবন্ত স্মারক" হিসেবে জিইয়ে রাখতে। তাঁর সেই বিদ্রুপাত্মক উক্তি আজও অনেকের কানে বাজে—"আমার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বলে মনরেগা কখনও বন্ধ করো না... আমি ঢাকঢোল পিটিয়ে এই স্মারকের ঘোষণা করতে থাকব।"
আজ এক দশক পর, সমালোচকরা বলছেন, সেই 'স্মারক' রাখার প্রতিশ্রুতি আসলে ছিল এক রাজনৈতিক চাল। যে প্রকল্পকে একদিন উপহাসের ছলে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল, আজ তাকেই নিঃশব্দে শ্বাসরোধ করে মারা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, গান্ধী পরিবারের নাম জড়িয়ে থাকা এই প্রকল্পের ওপর কি তবে রাজনৈতিক আক্রোশ মেটানো হচ্ছে? আর সেই আক্রোশের বলি হতে চলেছেন দেশের কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ?
ঐক্যের আইন আজ একতরফা সিদ্ধান্তে
মনরেগা যখন সংসদে পাশ হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল এক বিরল দৃশ্য। দলমত নির্বিশেষে সাংসদরা টেবিল চাপড়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন এই আইনকে। স্লোগান উঠেছিল—"রোজগার আইন জিন্দাবাদ, মানবতার কালো দাগ মুছে যাবে।" সেই আইন ছিল ভারতের সম্মিলিত রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতীক।
অথচ আজ? সেই সর্বসম্মত আইনকে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে সম্পূর্ণ একতরফাভাবে। আলোচনা নেই, বিতর্ক নেই—রয়েছে কেবল এক নীরব ও নিষ্ঠুর পরিবর্তন। যা ছিল গর্বের, তা আজ পরিণত হচ্ছে রাজনৈতিক উপেক্ষার বস্তুতে।
অধিকার হরণ: 'হক' থেকে 'দয়া'
সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে মনরেগার মূল আত্মায়। মনরেগা ছিল 'অধিকার-ভিত্তিক' আইন। অর্থাৎ, কাজ চাওয়া আপনার অধিকার, আর কাজ দেওয়া সরকারের আইনি বাধ্যবাধকতা। সোজা কথায়—"কাজ চাইলেই কাজ পাব।"
কিন্তু প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থায় এই সমীকরণ সম্পূর্ণ উল্টে দেওয়া হচ্ছে। এখন আর কাজ আপনার অধিকার নয়, বরং সরকারের ইচ্ছা। সরকার যখন চাইবে, যেখানে চাইবে, কেবল তখনই কাজ দেবে। এক লহমায় একজন স্বাধীন নাগরিকের আইনি অধিকারকে সরকারি অনুদান বা দয়ায় নামিয়ে আনা হলো।
১২৫ দিনের কাজের 'মরীচিকা'
নতুন প্রকল্পে শোনানো হচ্ছে ১২৫ দিনের কাজের লোভনীয় প্রতিশ্রুতি। মনে হতে পারে, ১০০ দিনের চেয়ে তো বেশি! কিন্তু সাবধান, এখানেই লুকিয়ে আছে আসল ফাঁকি। মনরেগায় ১০০ দিনের কাজের পেছনে ছিল আইনি 'গ্যারান্টি'। সরকার কাজ দিতে না পারলে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকত।
নতুন নিয়মে ১২৫ দিনের কথা বলা হলেও, তার কোনও আইনি গ্যারান্টি নেই। পুরোটাই নির্ভর করবে বাজেটের ওপর। সোজা কথায়—"টাকা থাকলে কাজ, না থাকলে বাড়ি যাও।" 'গ্যারান্টি' শব্দটি মুছে ফেলার অর্থ হলো, কাজ না পেলে সরকারের কলার ধরার অধিকারটুকুও আর সাধারণ মানুষের থাকল না। সেই পুরনো প্রবাদের মতোই—"না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।"
দিল্লি থেকে গ্রামের নিয়ন্ত্রণ: স্বায়ত্তশাসনের মৃত্যু
প্রস্তাবিত “বিকশিত ভারত গ্যারান্টি অ্যান্ড আজীবিকা মিশন গ্রামীণ” (VBG-RAM-ji) প্রকল্পে গ্রামের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা কুক্ষিগত করা হচ্ছে দিল্লির হাতে।
১. আর্থিক বোঝা: আগে মজুরির পুরো টাকা দিত কেন্দ্র। এখন ৪০ শতাংশ বোঝা চাপানো হচ্ছে রাজ্যের ঘাড়ে। অর্থাৎ রাজ্য দেউলিয়া হলে, পেটে টান পড়বে শ্রমিকের।
২. চাষের সময় কাজ বন্ধ: অদ্ভুত এক নিয়মে বলা হয়েছে, বীজ বপন আর ফসল কাটার সময় কাজ বন্ধ থাকবে। অথচ এই সময়েই ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকদের হাতে কাজ থাকে না। তাদের সেই বিপদের দিনেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ভাতের থালা।
৩. নজরদারির নামে প্রহসন: গ্রামের মানুষের সোশ্যাল অডিটের বদলে আনা হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ আর বায়োমেট্রিক নজরদারি। প্রযুক্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে আসল বঞ্চনার ছবি।
"মনরেগা চললে উনুন জ্বলে"—এই সহজ সত্যটা গ্রামীণ ভারতের প্রতিটি ধূলিকণা জানে। এই আইনের পরিবর্তন কোনও সাধারণ প্রশাসনিক রদবদল নয়, এটি গরিবের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। অধিকার কেড়ে নিয়ে দয়ার পাত্র বানানোর এই খেলায় হয়তো সরকারের খাতা কলমে অনেক সাশ্রয় হবে, কিন্তু কোটি কোটি মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দায় কে নেবে? গ্রামীণ ভারতের বুক থেকে কি তবে চিরতরে মুছে যেতে চলেছে 'গ্যারান্টি'র নিশ্চিন্তি? উত্তর দেবে সময়, কিন্তু ততক্ষণে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।


