নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় পার্ক স্ট্রিটের ওপর যখন নীল-সাদা আলোর ঝালরগুলো দুলতে থাকে, তখন হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। চারদিকে সান্টা টুপির লাল রঙের সমুদ্র, বাতাসে কেক আর ভাজা মাংসের সুবাস। কিন্তু এই রঙিন উৎসবের ঠিক কয়েক ফুট নিচেই চাপা পড়ে আছে এক অন্য কলকাতা— যেখানে অন্ধকার, নীরবতা আর চিরস্থায়ী বিচ্ছেদই ছিল একমাত্র সত্যি।
গোরস্থান থেকে জেগে ওঠা এক রাজপথ
আজকের উৎসবের এই রাজপথ ১৭৬০-এর দশকে ছিল নিছক এক জঙ্গলঘেরা পথ, যার নাম ছিল ‘বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’। সেই সময়ে আজকের আনন্দ নয়, এই রাস্তা দিয়ে বয়ে যেত ব্রিটিশ সাহেব-মেমদের কফিনের দীর্ঘ মিছিল। মশালের আলোয় ছায়া ফেলা সেই বিষণ্ণ পদযাত্রাগুলো শেষ হতো গিয়ে সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রিতে। সেখানে আজও ১৬০০-র বেশি মানুষ শুয়ে আছেন, যাঁদের দীর্ঘশ্বাস হয়তো এই উৎসবের কানফাটানো মিউজিকের নিচে কোথাও একাকী কেঁদে ফেরে।
সময়ের সাথে সাথে সেই শ্মশানপুরী হয়ে উঠল বিচারপতির প্রিয় হরিণ উদ্যান বা ‘ডিয়ার পার্ক’। আর সেখান থেকেই জন্ম নিল আজকের ‘পার্ক স্ট্রিট’। যে রাস্তায় এক সময় মরণের নিস্তব্ধতা ছিল, আজ সেখানে জীবনের জয়গান।
হারানো সুরের নস্টালজিয়া: সাহেব পাড়া থেকে চন্দননগর
পার্ক স্ট্রিটের বড়দিন মানে কেবল এক দিনের উৎসব নয়, এটি এক টুকরো হারানো কলকাতার গল্প। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যখন ট্রিনকাস বা ব্লু ফক্সের জানলা দিয়ে জ্যাজ মিউজিকের সুর আসত, তখন পার্ক স্ট্রিট ছিল সাহেবি আভিজাত্যের প্রতীক। আজকের পার্ক স্ট্রিট অনেক বেশি ‘বাঙালি’। চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি একেকটি নকশা যেন আমাদের এই মাটির শিল্পের জয়যাত্রা।
"পার্ক স্ট্রিট কোনোদিন বুড়ো হয় না। এটি সেই পুরনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলার মতো, যিনি আজও তাঁর সবটুকু আভিজাত্য নিয়ে লাঠি হাতে রাজপথে হাঁটেন," বলছিলেন এক প্রবীণ শহরবাসী।
কেন এই বড়দিন আজও কাঁদায়?
অনেকের কাছেই বড়দিন মানে শুধুই পার্টি, কিন্তু শহরের গলিতে থাকা সেই নিভে আসা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারগুলোর কাছে এটি হারানো স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দিন। পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে যখন ‘ক্যারল’ গাওয়া হয়, সেই সুরে যেমন আনন্দ থাকে, তেমনি থাকে ফেলে আসা ঐতিহ্যের বিষাদ।
এই যে কয়েক লক্ষ মানুষ বড়দিনে ভিড় করেন, তাঁরা হয়তো জানেনও না যে তাঁরা একটি বিশাল ইতিহাসের কবরের ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দ করছেন। কিন্তু এটাই কি কলকাতার জাদু নয়? যেখানে মৃত্যু আর জীবন হাত ধরাধরি করে চলে। যেখানে গোরস্থানের গেট দিয়ে ঢোকার কয়েক হাত দূরেই জ্বলে ওঠে হাজার হাজার বাতি।
পার্ক স্ট্রিটের বড়দিন কেবল একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়; এটি একটি চিরন্তন বিবর্তন। যেখানে অতীতে মশাল নিয়ে শোক মিছিল যেত, আজ সেখানে মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইটে সেলফি ওঠে। আলো হয়তো সেই অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের প্রতিটি ধুলিকণায় আজও মিশে আছে সেই পুরনো সাহেব পাড়ার নস্টালজিয়া আর এক গভীর একাকিত্ব।


