অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন সেন্টারে (কমরেড অনাথালাভত্তম আনন্দন নগর) অনুষ্ঠিত ১৮তম সিআইটিইউ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক তপন সেন এক ঐতিহাসিক ও সুদীর্ঘ ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়, শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বিকল্প গড়ে তোলার রূপরেখা তুলে ধরেন।
১. সম্মেলনের প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক সংহতি
তপন সেন তাঁর ভাষণে প্রথমেই উল্লেখ করেন যে, এই সম্মেলন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন পুঁজিবাদী বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের (WFTU) সাধারণ সম্পাদক পাম্বিস কিরিৎসিসের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সংহতির গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ভারতের শ্রমিকদের লড়াই কেবল জাতীয় নয়, এটি বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ।
২. শ্রম কোড বাতিল ও দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক
ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ৪টি শ্রম কোড বাতিলের দাবি। তপন সেন অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে জানান:
ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৬-এর সাধারণ ধর্মঘট: তিনি এই সম্মেলন থেকে ঘোষণা করেন যে, শ্রম কোড বাতিল এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২৬ তারিখে সারা দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে।
অধিকার হরণ: তিনি বলেন, এই শ্রম কোডগুলো আসলে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার এবং ধর্মঘট করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এটি মালিকপক্ষকে যখন-তখন শ্রমিক
৩. বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্ট ও বেসরকারিকরণ প্রতিরোধ
বিশাখাপত্তনমের মাটিতে দাঁড়িয়ে তপন সেন ভাইজ্যাগ স্টিল প্ল্যান্ট (VSP) রক্ষার লড়াইকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেন।
জাতীয় সম্পদ রক্ষা: তিনি বলেন, বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্ট কেবল একটি কারখানা নয়, এটি ভারতের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। একে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টাই সফল হতে দেওয়া হবে না।
গঙ্গাভরম বন্দর ও আদানি গোষ্ঠী: তিনি গঙ্গাভরম বন্দরকে আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, সরকার জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মুষ্টিমেয় কর্পোরেটদের পকেট ভারী করছে।
৪. শ্রমিক-কৃষক ঐক্য ও সামাজিক বিচার
তপন সেন তাঁর ভাষণে শ্রমিক ও কৃষকদের যৌথ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ জোর দেন:
মজদুর-কিষাণ লড়াই: তিনি বলেন, শ্রমিক ও কৃষকদের একজোট হয়ে লড়াই না করলে নব্য-উদারবাদী নীতিকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
সামাজিক শোষণ: তিনি দলিত, আদিবাসী এবং মহিলাদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের নিন্দা করেন এবং বলেন যে, সামাজিক বিচার ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।
৫. সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা
তিনি গভীর উদ্বেগের সাথে বলেন যে, যখনই শ্রমিকরা একজোট হয়, তখনই আরএসএস-বিজেপি জোট ধর্ম ও জাতপাতের নামে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করে।
ঐক্যের ডাক: তিনি নির্দেশ দেন যে, প্রতিটি কর্মীকে কেবল ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হলে চলবে না, তাঁদের হতে হবে সামাজিক রূপান্তরের কারিগর, যারা এই বিভাজনের রাজনীতিকে রুখে দেবে।
৬. আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা
তপন সেন কর্মীদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা দেন:
গিগ ও পরিযায়ী শ্রমিক: যারা অ্যাপ-ভিত্তিক কাজ করেন (যেমন ডেলিভারি বয়) এবং যারা ভিন রাজ্যে কাজে যান, তাঁদের দ্রুত সংগঠনের আওতায় আনতে হবে।
শ্রমিক সচেতনতা: প্রতিটি কারখানার গেটে গিয়ে শ্রম কোড এবং বেসরকারিকরণের কুফল সম্পর্কে সাধারণ শ্রমিকদের সচেতন করতে হবে।
তপন সেন তাঁর ভাষণের শেষে ঘোষণা করেন, "শ্রমিকরাই হলো দেশের ভাগ্যবিধাতা। আমরা লড়ব, আমরা জিতব।" তাঁর এই ভাষণ সম্মেলনে উপস্থিত ১,৩০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।





