নির্বাচন যত এগিয়ে আসে, বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া ততই মন্দির-মসজিদের কোলাহলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। টিভির পর্দা থেকে চায়ের দোকান, সর্বত্রই হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের রাজনীতি প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই চেনা বিতর্কের আড়ালে কি চাপা পড়ে যাচ্ছে আপনার-আমার দৈনন্দিন জীবনের আসল সমস্যাগুলো?
সম্প্রতি সিপিআই(এম) নেতা সৃজন ভট্টাচার্য্যের একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা এই প্রশ্নগুলোকেই নতুন করে সামনে এনেছে। তিনি এমন কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছেন যা রাজ্যের দুই প্রধান দলের তৈরি করা সাদা-কালো আখ্যানকে ভেঙে দেয়। এই পোস্টটিতে আমরা সেই বক্তৃতা থেকে উঠে আসা ৫টি গুরুত্বপূর্ণ এবং আশ্চর্যজনক দিক তুলে ধরব, যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আসল চালচিত্র বুঝতে সাহায্য করবে।
১. বিজেপির 'মুসলিম তাড়ানোর' ডাক আদতে হিন্দুদের জন্যই বেশি বিপজ্জনক?
বিজেপি নেতারা প্রায়শই ভোটার তালিকা থেকে কোটি কোটি "বাংলাদেশী মুসলমান"-এর নাম বাদ দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু এই প্রচারের বাস্তব পরিণতি কী হতে পারে? বক্তার মতে, এই প্রক্রিয়াটি মুসলিমদের চেয়ে হিন্দুদের জন্যই বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আসামের NRC (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি)। সেখানে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষই ছিলেন হিন্দু এবং মাত্র ৬ লক্ষ ছিলেন মুসলিম। বক্তা সেই ভয়ংকর বাস্তবতার কথা তুলে ধরে বলেন, এই মানুষদের ডিটেনশন ক্যাম্পে এমন অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছে, যেভাবে "মুরগির খাঁচায় মুরগিকে রাখে"।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গেও একই ধরনের প্রক্রিয়া চালু হলে সাধারণ, দরিদ্র হিন্দু পরিবারগুলি, বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষরা চরম সংকটে পড়বেন। যাঁরা বছরের পর বছর ধরে এদেশে ভোট দিয়ে আসছেন, বসবাস করছেন, তাঁদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য এমন সব পুরনো নথি চাওয়া হচ্ছে যা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। অথচ তাঁদের ভোটার কার্ডকেই যথেষ্ট প্রমাণ হিসেবে মানা হচ্ছে না। এর ফলে, মুসলমান তাড়ানোর নামে আদতে এদেশের হিন্দুরাই বেশি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
২. বিজেপির জুজু দেখিয়ে লাভ তৃণমূলের
বক্তা একটি আশ্চর্য রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন: বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তৃণমূলের জন্য পরাজয় নয়, বরং এক নিশ্চিত জয়ের ফর্মুলা। এই দুটি দলের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়ার সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে একের মেরুকরণের রাজনীতি অন্যের ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করতে সাহায্য করে।
তৃণমূল কংগ্রেস খুব সচেতনভাবেই "বিজেপির জুজু" বা ভয়কে ব্যবহার করে মানুষের নজর তাদের নিজেদের ব্যর্থতা থেকে সরিয়ে দেয়। যখনই মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখনই বিজেপিকে দেখিয়ে তৃণমূল নিজেদের ভোট সংহত করার চেষ্টা করে। এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডামাডোলে চাপা পড়ে যায় আসল সমস্যাগুলো, যেমন:
পার্থ চ্যাটার্জিদের মতো নেতাদের দুর্নীতি এবং ২৬,০০০ মানুষের চাকরি চলে যাওয়া।
রাজ্যে ৮,০০০ স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া।
পেট্রোল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি।
তৃণমূল জানে যে, রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে পারলেই মানুষের ক্ষোভকে কর্মসংস্থান, দুর্নীতি বা মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব।
৩. মন্দির-মসজিদ বিতর্কের আড়ালে চাপা পড়ছে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্ন
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই মন্দির-মসজিদের বিতর্কের আসল উদ্দেশ্য কী? বক্তার মতে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হলো সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নগুলোকে ধামাচাপা দেওয়া। "বাংলা বাঁচাও যাত্রা"-র উদ্দেশ্য হলো আলোচনার কেন্দ্রে "রুটি রুজির রাজনীতি"-কে ফিরিয়ে আনা।
মন্দির-মসজিদের কোলাহলে আমরা ভুলে যাই সেই প্রশ্নগুলো, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। যেমন:
বিদ্যুতের বিল কেন ক্রমাগত বাড়ছে?
স্কুল ও কলেজে ছাত্রছাত্রীরা স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ পাচ্ছে না কেন?
ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে কেন?
এই দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও দক্ষতার প্রয়োজন, কিন্তু ধর্মীয় বিভাজন উস্কে দেওয়া অনেক সহজ এবং রাজনৈতিকভাবে লাভজনক। এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব বোঝাতে বক্তার একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:
মন্দির মসজিদের সর্বনাশে বাংলার রাজনীতিকে ঢুকতে দেবেন না। যারা এই কাজ করছে...এতে লাভ আছে ভোট ভাগাভাগিতে কিন্তু আমাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের কথা না বললে আগামী প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে, সর্বনাশ হয়ে যাবে বাংলার।
৪. একই মুদ্রার দুই পিঠ? সুবিধাবাদী রাজনীতির চক্র
এই সাম্প্রদায়িক নাটকের কুশীলব কারা? বক্তা হুমায়ুন কবীরের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে একই ব্যক্তিরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা এবং তৃণমূলের আশ্রয়ের মধ্যে অবলীলায় যাতায়াত করে।
হুমায়ুন কবীর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন। ঠিক তার দুই বছর পর, ২০২১ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন। বক্তার অভিযোগ, হুমায়ুন কবীরের মতো ব্যক্তিরা এবং বিজেপি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার জন্য একই উৎস থেকে অর্থ সাহায্য পায় ("একই জায়গা থেকে পয়সা নিয়ে হুমায়ুন কোভিদ আর বিজেপি এরা একই সাথে এগুলো করছে")।
এর মাধ্যমে একটি বড় চিত্র স্পষ্ট হয়। মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস এই ধরনের সুবিধাবাদী এবং "দাঙ্গাবাজ" ব্যক্তিদের দলে আশ্রয় দেয়, কারণ এতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়। রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকলে শাসকদলের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কমে যায়।
৫. বিকল্প পথ: জীবন-জীবিকার লড়াই
এই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তির পথ কী? বক্তা একটি বিকল্প পথের কথা বলেছেন, যার মূল ভিত্তি হলো জীবন-জীবিকার লড়াই। "বাংলা বাঁচাও যাত্রা"-র উদ্দেশ্য হলো বাংলাকে তৃণমূল এবং বিজেপি, উভয় শক্তির হাত থেকে মুক্ত করা।
এই যাত্রার লক্ষ্য হলো বাংলার রাজনীতিতে আবারও "রুজি রুটির লড়াই"-কে প্রধান বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ—"দরিদ্র মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেত মজুর, ছাত্র, যুব, মহিলারা"। এই লড়াইয়ের লক্ষ্য কোনো বিভাজন নয়, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে একটি নতুন বাংলা গড়ে তোলা।
এই নতুন বাংলা গড়ার স্বপ্নই ধ্বনিত হয়েছে বক্তার শেষের স্লোগানে: "ভাঙ্গা বুকের পাজর দিয়ে নয়া বাংলা গর্ব"।
এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট: মন্দির-মসজিদকে কেন্দ্র করে যে তীব্র রাজনৈতিক কোলাহল আমরা শুনি, তা প্রায়শই একটি সুপরিকল্পিত কৌশল। এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে দুর্নীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির মতো কঠিন বাস্তব সমস্যাগুলোকে মানুষের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
ভোটের বোতাম টেপার আগে আপনি কি একবার ভেবে দেখবেন, আপনার জীবনে মন্দির-মসজিদের রাজনীতির প্রভাব বেশি, নাকি শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কর্মসংস্থানের?