মুম্বাই, ১২ নভেম্বর:
ভারতের শিল্প শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯১৮ সালের বোম্বে টেক্সটাইল মিল ধর্মঘট (The 1918 Bombay textile mills strike) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ঠিক যে দিনটিতে আমরা দেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার এবং তাঁদের ঐতিহাসিক সংগ্রামকে স্মরণ করি, সেই ১২ই নভেম্বর তারিখের আলোচনায় ১৯১৮ সালের এই ধর্মঘট উঠে আসে শ্রমিক শ্রেণির প্রথম বৃহৎ-স্কেলের ও সংগঠিত প্রতিবাদের উদাহরণ হিসেবে। এই ধর্মঘট ভারতে আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া এবং মজুরির সঙ্কট:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতের অর্থনীতিতে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়। একদিকে যেমন যুদ্ধের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল, তেমনই অন্যদিকে টেক্সটাইল মিলের মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে রাজি ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে মিল মালিকদের দ্বারা বার্ষিক বোনাস দিতে অস্বীকার করা শ্রমিকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। বিগত বছরগুলিতে এই বোনাস কর্মীদের কাছে এক প্রকার অতিরিক্ত মজুরি হিসেবে বিবেচিত হত। মূলত এই বোনাস পুনরায় চালু করা, ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য উচ্চ মজুরি এবং অমানবিক কাজের পরিবেশের উন্নতির দাবিতেই শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দেন।
ঐতিহাসিক সংগ্রামের রূপরেখা:
১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া এই ঐতিহাসিক ধর্মঘট প্রায় তিন মাস বা ৯০ দিনের দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। তৎকালীন বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) প্রায় ৮৩টি মিলের প্রায় দেড় লক্ষ (১,৫০,০০০) শ্রমিক এতে অংশ নিয়েছিলেন। এই ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে গোটা শহরের টেক্সটাইল শিল্প প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
ধর্মঘটে শুধু পুরুষ শ্রমিকরাই নন, প্রচুর সংখ্যক নারী ও শিশু শ্রমিকও সামিল হন। এটি সেই সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের একটি অভূতপূর্ব ঐক্যের উদাহরণ ছিল। ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং মালিক পক্ষের বিভিন্ন উস্কানি সত্ত্বেও শ্রমিকরা তাঁদের প্রতিবাদকে শান্তিপূর্ণ ও অহিংসভাবে (Non-violent) বজায় রেখেছিলেন। এটি ছিল শ্রমিকদের সুদৃঢ় সংকল্প এবং শৃঙ্খলার প্রমাণ।
মালিক পক্ষের কঠোরতা ও শ্রমিকের অধ্যবসায়:
প্রথমদিকে মিল মালিকরা শ্রমিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি হননি। তাঁরা ধর্মঘট ভাঙার জন্য লোকআউট ঘোষণা করেন, শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন এবং বিকল্প শ্রমিক (Blackleg labor) নিয়োগের চেষ্টা করেন। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার বা ব্রিটেনের শ্রমিক দল (British Labour Party)-এর পক্ষ থেকে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ না আসায় শ্রমিকরা নিজেদের ঐক্য ও সংকল্পের ওপর ভরসা করে লড়াই চালিয়ে যান। এটি ছিল শ্রমজীবী মানুষের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্ব-নির্ভর সংগ্রামের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ধর্মঘট চলাকালীন শ্রমিকরা কাজের সময়ের দৈনিক ৮ ঘন্টা কমানো, সাপ্তাহিক ছুটি চালু করা এবং যথেচ্ছ জরিমানা (fines) বাতিল করার মতো উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিগুলিও তুলে ধরেন। এটি কেবল বোনাসের দাবি ছিল না, এটি ছিল শ্রমিক হিসেবে মর্যাদা ও ন্যায্য জীবনযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি।
ফলাফল ও আন্দোলনের নতুন দিগন্ত:
দীর্ঘ এবং কঠিন এই সংগ্রাম অবশেষে নিয়োগকর্তাদের মজুরি কর্তনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে এবং শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করে। যদিও ধর্মঘটের ফলে শ্রমিকদের সব দাবি সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়নি, তবুও এই আন্দোলন মালিকপক্ষকে মজুরি বাড়াতে বাধ্য করে এবং শ্রমিকদের একটি নৈতিক জয় এনে দেয়।
বোম্বে টেক্সটাইল মিল ধর্মঘট শুধু একটি স্থানীয় ধর্মঘট ছিল না; এটি ভারতের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই ঘটনাটি বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করে শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের শক্তি প্রদর্শন করে। এই আন্দোলনের সফল পরিণতি পরবর্তীকালে ভারতে ট্রেড ইউনিয়নগুলির উত্থান ও ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল।
আজও, ১৯১৮ সালের এই ধর্মঘট ভারতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংকল্প, ঐক্য ও অহিংস প্রতিবাদের ঐতিহাসিক প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।