" " //psuftoum.com/4/5191039 Live Web Directory ৯ ডিসেম্বরের সেই মহীয়সী: যিনি একাই লড়াই করেছিলেন হাজার বছরের অন্ধকারের সাথে //whairtoa.com/4/5181814
Type Here to Get Search Results !

৯ ডিসেম্বরের সেই মহীয়সী: যিনি একাই লড়াই করেছিলেন হাজার বছরের অন্ধকারের সাথে

 


বিশেষ প্রতিবেদক | ঢাকা

ইতিহাসে কিছু দিন থাকে যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর জন্য আসে না, আসে একটি জাতির ভাগ্য বদলে দেওয়ার বার্তা নিয়ে। ৯ ডিসেম্বর তেমনই একটি দিন। ১৮৮০ সালের এই দিনে রংপুরের পায়রাবন্দের নিভৃত পল্লীতে যখন এক কন্যাশিশুর জন্ম হয়, তখন কেউ জানত না যে এই মেয়েটি একদিন কাঁপিয়ে দেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। আবার ১৯৩২ সালের ঠিক এই তারিখেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। জন্ম ও মৃত্যুর এই আশ্চর্য সমাপতনের মাঝখানের ৫২ বছর ছিল এক অবিরাম যুদ্ধের গল্প—যে যুদ্ধ ছিল অসি নয়, মসির; যে যুদ্ধ ছিল তরবারি নয়, শিক্ষার।

আজকের ঝকঝকে আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন, সেই সময় নারীর জীবন কতটা দুর্বিষহ ছিল। নারীরা ছিল কেবল চার দেয়ালের ভেতরের আসবাবমাত্র। সেই দমবন্ধ করা সময়ে, ঘন অন্ধকারের বুকে যিনি প্রথম প্রদীপটি জ্বেলেছিলেন, তিনি আমাদের বেগম রোকেয়া।

মোমবাতির আলোয় চোর-পুলিশ খেলা ও শিক্ষার হাতেখড়ি
পায়রাবন্দের সেই জমিদার বাড়িটি ছিল বিশাল, কিন্তু নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল কেবল অন্দরমহল। বাবা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন বহুভাষাবিদ, কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন ঘোর রক্ষণশীল। সেই রক্ষণশীলতার প্রাচীর ডিঙিয়ে রোকেয়াকে আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং বড় বোন করিমুন্নেসা।

গভীর রাতে যখন গোটা বাড়ি ঘুমে অচেতন, তখন মোমবাতির টিমটিমে আলোয় ভাই-বোনের মধ্যে চলত জ্ঞান আহরণের এক গোপন যজ্ঞ। ধরা পড়ার ভয়ে কখনো কখনো বই লুকিয়ে ফেলতে হতো। এই ‘চোর-পুলিশ’ খেলার মধ্য দিয়েই রোকেয়া শিখেছিলেন বাংলা ও ইংরেজি। সমাজ তাকে বলেছিল, "ফারসি শেখো, ধর্মগ্রন্থ পড়ো, এর বেশি নয়।" কিন্তু রোকেয়া জানতেন, বিশ্বকে জানতে হলে ইংরেজি আর নিজের শেকড়কে জানতে হলে বাংলা শিখতেই হবে। সেই মোমবাতির ক্ষীণ আলোই পরবর্তীকালে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের প্রতিটি নারীর হৃদয়ে।

স্বামীর ছায়ায় এক নতুন জন্ম
মাত্র ১৬-১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে নারীর শেকল হয়ে দাঁড়ালেও, রোকেয়ার ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে মুক্তির সনদ। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন উদারমনা ও দূরদর্শী মানুষ। তিনি স্ত্রীর মেধার কদর বুঝেছিলেন। তিনি রোকেয়াকে কেবল উৎসাহিতই করেননি, বরং বিশ্বসাহিত্যের দরজা খুলে দিয়েছিলেন তাঁর সামনে। স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই রোকেয়া পুরোদমে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ গল্পের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

স্বপ্নভঙ্গ ও একাকী লড়াইয়ের সূচনা
সুখ বেশিদিন সয়নি। ১৯০৯ সালে অকাল মৃত্যু হয় স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিধবা হন রোকেয়া। সমাজ ভেবেছিল, এইবার বুঝি মেয়েটি থামবে। কিন্তু রোকেয়া থামেননি। স্বামীর জমানো সামান্য অর্থ সম্বল করে তিনি শুরু করলেন এক নতুন সংগ্রাম—নারী শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, "স্বামী মারা গেছেন, কিন্তু আমার কাজ তো শেষ হয়নি।"

সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল: এক অশ্রুসিক্ত সংগ্রাম
১৯১১ সালে কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। শুরুটা ছিল অত্যন্ত করুণ। মাত্র ৮ জন ছাত্রী। ছাত্রী সংগ্রহের জন্য তিনি অভিজাত মুসলিম পরিবারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে সমাজের প্রবল ঘৃণা, কটূক্তি, এবং মোল্লাদের ফতোয়া। লোকেরা তাঁর গায়ে ধুলো ছিটিয়েছে, পাগল বলেছে। কিন্তু তিনি ছিলেন ইস্পাতকঠিন। তিনি জানতেন, একটি মেয়েকে শিক্ষিত করা মানে একটি প্রজন্মকে শিক্ষিত করা। তিনি বলতেন, "কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জনে সক্ষম হউক।"

কলম যখন আগ্নেয়গিরি: সাহিত্য ও দর্শন
বেগম রোকেয়া কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি কলমকে বানিয়েছিলেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তাঁর সাহিত্য ছিল বারুদ।

  • সুলতানাস ড্রিম (Sultana’s Dream): ১৯০৫ সালে লেখা এই গ্রন্থে তিনি দেখালেন এক কল্পনার জগত ‘ল্যাডিল্যান্ড’ (Ladyland)। যেখানে নারীরা বিজ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার জোরে রাজ্য চালায়, সৌরশক্তি ব্যবহার করে, মেঘ থেকে জল সংগ্রহ করে। আর পুরুষেরা থাকে অন্দরমহলে। নারীবাদী ইউটোপিয়ার এমন নিদর্শন বিশ্বসাহিত্যে বিরল।

  • অবরোধবাসিনী: এই বইতে তিনি ৪৭টি সত্য ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরলেন পর্দা প্রথার নামে নারীদের ওপর চলা অমানবিক প্রহসনের চিত্র। কীভাবে পর্দার আড়ালে থাকতে গিয়ে আগুন লাগার পরও নারীরা ঘর থেকে বের হননি এবং পুড়ে মরেছেন—তা পড়ে আজও গা শিউরে ওঠে।

  • মতিচূর: এখানে তিনি শোনালেন সাম্যের গান। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, "আমরা সমাজেরই অর্ধঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে কি খুড়াইয়া খুড়াইয়া কতদূর চলিবে?"

সমাজ সংস্কার ও শেষ দিনগুলো
তিনি কেবল লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম’। এটি ছিল নারীদের জন্য এক আশ্রয়স্থল। এখানে বিধবা ও দুস্থ নারীদের হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করা হতো, দেওয়া হতো অর্থ সাহায্য। তিনি চেয়েছিলেন নারী যেন কারো দয়ার পাত্রী না হয়।

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেও তিনি লিখে যাচ্ছিলেন ‘নারীর অধিকার’ বিষয়ক একটি প্রবন্ধ। টেবিলের ওপর সেই অসমাপ্ত লেখা রেখেই তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। কাজ করতে করতেই তিনি বিদায় নিলেন, যেন বলে গেলেন—"আমার কাজ শেষ হয়নি, বাকিটা তোমাদের করতে হবে।"

আজকের দিনে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা
আজ যখন বাংলাদেশের নারীরা হিমালয় জয় করছে, দেশ শাসন করছে, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা—সবখানে নিজেদের স্বাক্ষর রাখছে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে এই পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ ছিল। বেগম রোকেয়া সেই কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিষ্কার করে না গেলে আজকের এই জাগরণ হয়তো আরও ১০০ বছর পিছিয়ে যেত।

রংপুরের পায়রাবন্দের সেই মেয়েটি আজ আর কেবল একটি নাম নয়, তিনি একটি দর্শন, একটি চেতনা, একটি আন্দোলন। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন কোনো নারী শিক্ষার আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করবে, ততদিন বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকবেন নক্ষত্র হয়ে।

আজ তাঁর ১৪৫তম জন্ম ও ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহীয়সী নারীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies