নিজস্ব সংবাদদাতা, বহরমপুর: ভাগীরথীর তীরে তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা নামছে। আকাশের রঙ আর মাঠের পতাকার রঙ মিলেমিশে একাকার। কিন্তু বহরমপুরের স্টেডিয়াম চত্বরে আজ শুধু স্লোগান ছিল না, ছিল এক বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস। হাজার হাজার মানুষের ভিড়, কিন্তু সেই ভিড়ের মাঝে কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল শুধুই হাহাকার—কাজ হারানোর যন্ত্রণা, সন্তানকে ভিনরাজ্যে পাঠানোর আতঙ্ক আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জমানো ক্ষোভ।
সিপিআইএম-এর 'বাংলা বাঁচাও যাত্রা' আজ মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছাল। আর সেই মঞ্চ থেকেই তিন বক্তা—মীনাক্ষী মুখার্জি, এবং মহম্মদ সেলিম—যা বললেন, তা কোনো রাজনৈতিক ভাষণ ছিল না; ছিল বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির এক করুণ আলেখ্য।
"কেরালাগামী ট্রেন মানেই এখন আতঙ্কের সাইরেন"
সভার আবহাওয়ার মোড় ঘুরে গেল যখন ডিওয়াইএফআই নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি মাইক হাতে তুলে নিলেন। তাঁর গলায় আজ প্রতিবাদের ঝড়ের চেয়ে বেশি ছিল বেদনার সুর। মীনাক্ষী সোজাসুজি তাকালেন সামনের সারিতে বসে থাকা বিড়ি শ্রমিক মায়েদের দিকে।
তিনি বললেন, "এই মাঠের বাইরে এক মা আমাকে হাত ধরে বলছিলেন, তাঁর উনিশ বছরের ছেলেটা গত সপ্তাহে চেন্নাই গেছে। ছেলেটা বাড়ি ফেরার কথা বলে না, ভয় পায়। ভয় পায়, কারণ নিজের দেশে সে কাজ পায় না, আর ভিনরাজ্যে তাকে 'বহিরাগত' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়।"
মীনাক্ষীর গলা ধরে এল, "মুর্শিদাবাদের স্টেশনগুলো আজ সাক্ষী। প্রতিদিন হাজার হাজার যুবক ট্রেন ধরছে পেটের দায়ে। এই ট্রেনগুলো আজ আর শুধু জীবিকার বাহন নয়, এগুলো এক একটা লাশবাহী গাড়িতে পরিণত হয়েছে। মায়েরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলের ফেরার আশায়, আর ফেরে ছেলের কফিনবন্দী দেহ। এই কি আমাদের সোনার বাংলা? আমরা ভিক্ষা চাইছি না, আমরা চাইছি আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা, আমাদের নিজের মাটিতে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার।"
মীনাক্ষীর এই কথায় মাঠের বহু কোণ থেকে তখন ফুপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল।
"শিক্ষকের হাতে চক নেই, নেতার পকেটে লুটের টাকা"
ভালো করে দেখুন এই হাতগুলোর দিকে। এই হাত কাজ করতে জানে, এই হাত গড়তে জানে। কিন্তু এই সরকার কী করল? যোগ্য শিক্ষকের হাত থেকে চক-ডাস্টার কেড়ে নিয়ে তাঁদের রাস্তায় বসিয়ে দিল, আর নেতাদের আলমারি ভরে উঠল লুটের টাকায়।"
তিনি আরও বলেন, "মুর্শিদাবাদের যে ছেলেটা বা মেয়েটা রাত জেগে পড়াশোনা করে টেট পাশ করেছিল, আজ সে হতাশায় ধুঁকছে। যখন একটা চাকরি চুরি হয়, তখন শুধু একটা বেতন চুরি হয় না—চুরি হয় একটা গোটা পরিবারের স্বপ্ন, চুরি হয় একটা বাবার ওষুধের খরচ, একটা মায়ের মুখের হাসি। আমরা এই লুটের রাজত্ব শেষ করতে এসেছি।"
"গঙ্গা যখন ভাঙে, তখন হিন্দু-মুসলমান দেখে না"
সভার শেষে যখন সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বক্তব্য রাখতে উঠলেন, তখন গোটা মাঠ স্তব্ধ। মাটির কাছাকাছি থাকা এই নেতা মুর্শিদাবাদের মানুষের মনের ভাষাটা জানেন। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে তিনি গড়লেন এক সম্প্রীতির দেওয়াল।
সেলিম বললেন, "মুর্শিদাবাদ শুধু একটা জেলা নয়, এ হল বাংলার ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু আজ শকুনেরা আমাদের ছিঁড়ে খেতে চাইছে। একদল ধর্মের নামে আমাদের ভাগ করতে চায়, আরেকদল ভয়ের শাসন চালাতে চায়। কিন্তু মনে রাখবেন, ক্ষিদের কোনো ধর্ম হয় না।"
সামসেরগঞ্জের গঙ্গা ভাঙনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, "যখন গঙ্গা পাড় ভাঙে, যখন ভিটেমাটি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়, তখন নদী জিজ্ঞাসা করে না ঘরটা হিন্দুর না মুসলমানের। সর্বস্বান্ত আমরা সবাই হই। এই 'বাংলা বাঁচাও যাত্রা' কোনো দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়, এ যাত্রা বাংলার মানুষের হৃত সম্মান ফিরিয়ে আনার লড়াই। আমাদের এই ঐক্যের দেওয়াল ভাঙার সাধ্য কোনো দাঙ্গাবাজের নেই।"
অশ্রুসজল চোখে শপথ
সভা যখন শেষ হলো, তখন চারদিক অন্ধকার। কিন্তু হাজার হাজার টর্চ আর মোবাইলে আলোয় এক অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। 'উই শ্যাল ওভারকাম'-এর সুরে তখন গলা মেলাচ্ছেন হাজারো মানুষ।
সভার শেষে লাল ঝান্ডা গুটোতে গুটোতে ডোমকলের ষাটোর্ধ্ব আমিনা বিবি চোখের জল মুছলেন। বিড়ি বেঁধে সংসার চালানো এই বৃদ্ধা বললেন, "আজ মনে হলো কেউ আমাদের কথাগুলো বলল। আমার নাতনিটা এমএ পাশ করে ঘরে বসে আছে। সেলিম ভাই যা বললেন, তা তো আমাদেরই জীবনের কথা। অনেকদিন পর বুকে একটু ভরসা পেলাম।"
মুর্শিদাবাদের মাটি আজ সাক্ষী রইল এক অন্যরকম রাজনীতির, যেখানে হুঙ্কারের চেয়েও বেশি ছিল মানুষের চোখের জলের দাম। 'বাংলা বাঁচাও যাত্রা' হয়তো কাল অন্য জেলায় যাবে, কিন্তু আজকের এই সন্ধ্যার রেশ মুর্শিদাবাদের মানুষের মনে থেকে যাবে বহুদিন।