ফ্যানি শুনহেইট: স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের যমদূত সেই ডাচ 'মেশিনগান রানি'
১৯৬১ সালের এই দিনে তাঁর প্রয়াণ ঘটেছিল; আজ ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে ফিরে দেখা এক অদম্য যোদ্ধার জীবন।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
আজ থেকে ঠিক ৬৪ বছর আগে, ১৯৬১ সালের এই দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন ফ্যানি শুনহেইট। তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক ডাচ সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার, যিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় "কুইন অফ দ্য মেশিন গান" বা "মেশিনগানের রানি" হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হলেও, আজ ২০২৫ সালেও তাঁর গল্প ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতির এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শৈশব ও বার্সেলোনার লড়াই
১৯১২ সালের ১৫ জুন নেদারল্যান্ডসের রটারডামে ফার্নান্দা উইলহেলমিনা মারিয়া আলবার্টিনা শুনহেইট হিসেবে তাঁর জন্ম। ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে যখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তিনি তখন পেশাগত কারণে বার্সেলোনায় অবস্থান করছিলেন। একজন একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট হিসেবে শুনহেইট কালক্ষেপণ না করে রিপাবলিকান মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। শহরের ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থান দমনে তিনি সরাসরি রাস্তায় লড়াইয়ে অংশ নেন এবং দ্রুত আরাগন ফ্রন্টে চলে যান, যেখানে তিনি একজন দক্ষ মেশিনগান চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
"শোনা যায়, শুনহেইট ছিলেন একমাত্র ডাচ নারী যিনি সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন। লম্বা, স্বর্ণকেশী এবং শান্ত স্বভাবের ফ্যানি যখন মেশিনগান হাতে নিতেন, তখন রণক্ষেত্র কেঁপে উঠত।"
সম্মুখ সমরের বীরত্ব
স্প্যানিশ রিপাবলিককে রক্ষা করতে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক সমবেত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে শুনহেইট তাঁর অসামান্য পারদর্শিতার জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি পান। ১৯৩৭ সালে সম্মুখ সমরে গুরুতর আহত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন, এরপর বাধ্য হয়ে তাঁকে রণক্ষেত্র ছাড়তে হয়।
তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ বিদেশি নারী সেবিকা বা সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও, শুনহেইটের সরাসরি যুদ্ধ অংশগ্রহণ রিপাবলিকান আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় ভূমিকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৪০,০০০ আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক 'ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে' যোগ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বড় লড়াইয়ের পূর্বাভাস ছিল।
নির্বাসন ও আলোকচিত্রী জীবন
রিপাবলিকানদের পরাজয়ের পর শুনহেইট নির্বাসনের মুখে পড়েন। বিজয়ী ফ্রাঙ্কো সরকার তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। ১৯৪০ সালে একদল স্প্যানিশ শরণার্থীর সঙ্গে তিনি ডোমিনিকান রিপাবলিক চলে যান। সেখানে এবং পরবর্তীতে কুরাসাও-তে (তৎকালীন ডাচ উপনিবেশ) তিনি 'ফ্যানি লোপেজ' নাম ধারণ করে একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন।
তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলো কিছুটা রহস্যের ঘেরাটোপে ঢাকা ছিল। ১৯৬১ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বীরত্ব এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের এক অনন্য উত্তরাধিকার রেখে গেছেন তিনি।
কেন আজও তিনি প্রাসঙ্গিক?
ইতিহাসবিদ এবং সমাজকর্মীরা আজও শুনহেইটের মতো ব্যক্তিত্বদের স্মরণ করেন, যাঁদের অবদান বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সংজ্ঞায়িত দ্বন্দ্বে গণতন্ত্র ও শ্রমিক অধিকারের বিশ্বব্যাপী লড়াইকে ত্বরান্বিত করেছিল। আজকের যুগেও যখন কর্তৃত্ববাদী শক্তির আস্ফালন দেখা যায়, তখন তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সংকল্প কতটা শক্তিশালী হতে পারে।
© ২০২৫ বিশ্ব সংবাদ সংস্থা | সংগৃহীত এবং সম্পাদিত


