নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা
একটি সাজানো অভিযোগ, একদল উন্মত্ত জনতা আর কয়েক শ স্মার্টফোনের ক্যামেরা—এই ত্রয়ীর বলি হলেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার সুপারভাইজার দীপু চন্দ্র দাস। স্রেফ পেশাগত প্রতিহিংসা থেকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যে তকমা দিয়ে একজন জ্যান্ত মানুষকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার এই নারকীয় ঘটনায় স্তম্ভিত বিবেকবান মানুষ।
ঘটনার সূত্রপাত: প্রমোশন ও প্রতিহিংসা
নিহত দীপু দাস তার কর্মদক্ষতায় সম্প্রতি কারখানায় সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি পান। জানা গেছে, ওই পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, যারা দীপুর এই সাফল্য মেনে নিতে পারেনি। পাওনা টাকার হিসাব নিয়ে বিরোধের জেরে তারা দীপুকে সরিয়ে দেওয়ার এক ভয়াবহ ছক আঁকে।
গুজব ও নির্মম হত্যাকাণ্ড
দীপু দাস নিজে একটি সাধারণ বাটন ফোন ব্যবহার করতেন। অথচ তার নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে ধর্ম অবমাননার পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই কারখানার পাশে এক বিশাল 'মব' বা উন্মত্ত জনতা সৃষ্টি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা তথ্যে জানা যায়:
* প্রথমে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আধমরা করা হয়।
* এরপর গলায় দড়ি বেঁধে একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
* সবশেষে, উপস্থিত শত শত মানুষের উল্লাসের মধ্যে তার অর্ধমৃত দেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বিবেক যখন স্তব্ধ ক্যামেরার লেন্সের পেছনে
শিক্ষিকা শাকিলা নাছরিন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে লিখেছেন, "এই দৃশ্য ভিডিও করার জন্য কয়েক শ মানুষ স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা অন করেছিল, কিন্তু কারোরই মনে হয়নি এগিয়ে গিয়ে বাধা দেওয়ার। ইসলাম শান্তির ধর্ম বলে আমরা বড়াই করি, অথচ জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরে কি ইসলামের সম্মান রক্ষা হলো?"
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, যদি দীপু অপরাধ করেই থাকত, তবে কেন তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হলো না? কেন একদল মানুষ নিজেরাই বিচারক ও জল্লাদ হয়ে উঠল?
একটি পরিবারের হাহাকার
দীপু দাসের মৃত্যুতে নিঃস্ব হয়ে গেছে তার অসহায় বাবা-মা, সদ্য বিধবা স্ত্রী এবং পিতৃহারা অবুঝ সন্তান। অপরাধীরা হয়তো সাময়িক উল্লাস করছে, কিন্তু একটি নিরীহ পরিবারের এই আর্তনাদ আর অভিশাপ কি সমাজ সইতে পারবে? নেটিজেনদের দাবি, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা উস্কানিদাতা এবং সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
আমার মন্তব্য: এই ঘটনাটি আমাদের সমাজের বিচারহীনতা এবং উগ্র মানসিকতার এক চরম বহিঃপ্রকাশ। একজন নিরপরাধ মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা করা কেবল মানবতাবিরোধী নয়, বরং ধর্মেরই অবমাননা।


