নিজস্ব সংবাদদাতা, বেলঘরিয়া: ২৯ নভেম্বর কোচবিহারের তুফানগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া সিপিআই(এম)-এর দীর্ঘ ১৯ দিনের ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’র সমাপ্তি হলো উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়া-কামারহাটি অঞ্চলে। ১৭ ডিসেম্বর, বুধবার, বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়া মাঠে আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপিআই(এম) নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য দলীয় কর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
সমাবেশে মীনাক্ষী মুখার্জি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী, পলাশ দাস সহ বামফ্রন্টের অন্যান্য নেতৃত্ব। তবে এদিনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ডিওয়াইএফআই নেত্রী মীনাক্ষী, যিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন।
লড়াইয়ের নতুন সূচনা
মীনাক্ষী তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করে দেন যে, এই সমাবেশ যাত্রার সমাপ্তি হলেও এটি একটি বৃহত্তর লড়াইয়ের সূচনা। তিনি বলেন, “বাংলা বাঁচাও যাত্রা আজ শেষ হতে পারে, কিন্তু লড়াই শেষ হয়নি। কোচবিহার থেকে কামারহাটি পর্যন্ত আমরা মানুষের চোখে ভয় আর জীর্ণতা দেখেছি। মানুষ আমাদের হাত ধরে বলেছে—আমাদের বাঁচান।” তিনি কর্মীদের সতর্ক করে বলেন, বুথ স্তরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। তাঁর কথায়, “যদি মাঠের পিচে টিকে থাকতে পারি, রান উঠবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।”
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বড় প্রতিশ্রুতি
রাজ্যের বেকারত্ব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে মীনাক্ষী ২০২৬-এর নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে তিনটি বড় কাজের প্রতিশ্রুতি দেন:
১. স্বাস্থ্য সুরক্ষা: পরিযায়ী শ্রমিকরা যে রাজ্যে কাজ করবেন, সেই রাজ্যেই তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্ব নেবে সরকার।
২. রেশন ব্যবস্থা: প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য সেই রাজ্যেই রেশনের ব্যবস্থা করা হবে।
৩. শ্রমিক স্বীকৃতি: সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সরকারিভাবে ‘শ্রমিক’-এর মর্যাদা ও পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।
রাজ্য সরকারের ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ নিয়ে কটাক্ষ
মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসংস্থানের দাবিকে নস্যাৎ করে মীনাক্ষী পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন ২ কোটি চাকরি দিয়েছেন। সেই হিসেবে প্রতি বুথে ২৪৮ জন করে চাকরি পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে একজনও হাত তুলে বলতে পারবেন না যে তিনি চাকরি পেয়েছেন।” তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্যে ৮,৩২২টি সরকারি স্কুলে তালা ঝুলছে, অথচ ২২,০০০ নতুন মদের দোকান ও লটারির ঠেক খোলা হয়েছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বদলে সরকার যুবসমাজকে নেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে তিনি তোপ দাগেন।
আরজি কর ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা উল্লেখ করে মীনাক্ষী বলেন, “সরকারি হাসপাতালে একজন সরকারি ডাক্তারের খুন হওয়ার পর প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হলো। যারা দেহ তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দিল, তাদের শাস্তি না দিয়ে উল্টে পুরস্কৃত করা হলো।” রাজ্যের রেশন দুর্নীতি, নিয়োগ দুর্নীতি এবং বালি-কয়লা পাচার নিয়েও তিনি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে ‘লুটেরার সরকার’ বলে অভিহিত করেন।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ
বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে মীনাক্ষী বলেন, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের মতো ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যে হাজার হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রেল ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। তিনি বলেন, “রেলে আগে ১৩ লক্ষ কর্মী ছিল, এখন তা ১২ লক্ষে নেমেছে। গরিব মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নিয়ে দেশকে ‘বিশ্বগুরু’ বানানোর স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।”
সমাবেশ শেষে দেওয়ানপাড়া মাঠ ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। মহম্মদ সেলিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই যাত্রা রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন তুফান তুলবে। মীনাক্ষী মুখার্জির ভাষায়, ২০২৬-এর নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপির ‘গুন্ডারাজ’ ও ‘ভাগাভাগির রাজনীতি’র বিরুদ্ধে আসল রায় দেবে বাংলার মানুষ। ১৯ দিনের এই যাত্রা শেষ হলেও, রাজনীতির ময়দানে এর উত্তাপ যে আগামী দিনগুলোতেও বজায় থাকবে, তা এদিনের ভিড় ও কর্মীদের উচ্ছ্বাসেই স্পষ্ট ছিল।


