নয়াদিল্লি: ভারতীয় এভিয়েশন বা বিমান পরিবহণ খাতে ইন্ডিগো (IndiGo) বর্তমানে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেখানে অনেক এয়ারলাইন টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ইন্ডিগো শুধুমাত্র নিজেদের অবস্থান শক্ত করেনি, বরং ৬০ শতাংশেরও বেশি মার্কেট শেয়ার বা বাজার দখল করে ভারতের আকাশে রাজত্ব করছে। একটি সাধারণ 'লো-কস্ট ক্যারিয়ার' বা কম খরচের বিমান সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে কীভাবে তারা আজ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইন হয়ে উঠল, তা এক বিস্ময়কর ব্যবসায়িক কেস স্টাডি।
সাফল্যের মূলমন্ত্র: সুনির্দিষ্ট কৌশল ও দক্ষতা
ইন্ডিগোর এই বিশাল সাফল্যের পেছনে কোনো জাদুর কাঠি নেই, আছে সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা এবং কঠোর খরচ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। তাদের ব্যবসায়িক মডেলের প্রধান দিকগুলো হলো:
১. একই ধরণের বিমান ব্যবহার (Fleet Standardization):
ইন্ডিগোর সবচেয়ে বড় কৌশল হলো তাদের বিমানে বৈচিত্র্য না রাখা। তারা মূলত এয়ারবাস এ৩২০ (Airbus A320) ফ্যামিলির বিমান ব্যবহার করে। এর ফলে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, পাইলট ও ক্রুদের প্রশিক্ষণ এবং যন্ত্রাংশ মজুত করার খরচ বিপুলভাবে কমে যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র এই 'ফ্লিট স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন'-এর কারণে ইন্ডিগো বছরে প্রায় ১.৭৫ থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করে। এই সাশ্রয়ের একটি বড় অংশ আসে রক্ষণাবেক্ষণ (৩০-৩৫%) এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ খাতের (২০-২৫%) খরচ কমানোর মাধ্যমে।
২. অপারেশনাল দক্ষতা ও সময়ানুবর্তিতা:
যাত্রীদের কাছে ইন্ডিগো মানেই 'অন-টাইম' বা সঠিক সময়ে উড্ডয়ন। বিমান অবতরণ এবং পরবর্তী উড্ডয়নের মধ্যবর্তী সময় বা 'টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম' তারা মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে নামিয়ে এনেছে। এই দ্রুত গতির কারণে তাদের বিমানগুলো দিনে বেশি সময় আকাশে থাকে, যা তাদের আয় বাড়াতে সাহায্য করে।
৩. খরচ নিয়ন্ত্রণ বা কস্ট লিডারশিপ:
বিলাসবহুল সেবা বা ফ্রি খাবারের পরিবর্তে ইন্ডিগো নিরাপদ এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানোকেই অগ্রাধিকার দেয়। এছাড়া 'সেল অ্যান্ড লিজব্যাক' (Sale and Leaseback) পদ্ধতির মাধ্যমে তারা বিমান কেনে এবং লিজ দেয়, যা তাদের মূলধন আটকে থাকা থেকে বাঁচায় এবং ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার রাখে।
বাজারের বর্তমান চিত্র
২০২৫ সালের শেষের দিকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইন্ডিগো ভারতের অভ্যন্তরীণ বা ডোমেস্টিক মার্কেটের প্রায় ৬৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ার ইন্ডিয়া বা টাটা গ্রুপ তাদের চেয়ে বেশ অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে ইন্ডিগো সপ্তাহে ১৫,০০০-এর বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করে এবং তাদের ফ্লাইটে যাত্রী পূর্ণ হওয়ার হার (Passenger Load Factor) প্রায় ৮৪-৮৬ শতাংশ, যা শিল্পের অন্যতম সেরা।
ভবিষ্যৎ ও শিক্ষা
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং সাপ্লাই চেইনের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইন্ডিগো টানা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লাভজনক ব্যবসা করে আসছে। তাদের এই উত্থান প্রমাণ করে যে, স্থানীয় বাজারের চাহিদা বোঝা এবং খরচের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হলে যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শীর্ষস্থান দখল করা সম্ভব। ব্যবসায়িক বিশ্লেষকদের মতে, ইন্ডিগোর এই মডেল বা কেস স্টাডি শুধুমাত্র এভিয়েশন সেক্টর নয়, যেকোনো ব্যবসার জন্যই একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ।