প্রতি বছর ২রা ডিসেম্বর দিনটি আমাদের সভ্যতার গায়ে লেগে থাকা এক দগদগে ক্ষতের কথা মনে করিয়ে দেয়। জাতিসংঘ পালিত 'আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস' কেবল একটি তারিখ নয়, এটি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। ১৯৪৯ সালের এই দিনে মানুষের পাচার ও শোষণ রোধে জাতিসংঘে একটি ঐতিহাসিক কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই মুক্ত?
আজও বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের নিগড়ে বন্দী। মানব পাচার থেকে শুরু করে জোরপূর্বক শ্রম—সভ্যতার চাকচিক্যের আড়ালে এই ভয়াবহ অপরাধগুলো নীরবে ঘটে চলেছে। ২০২৫ সালে এসে, সচেতনতা বৃদ্ধির এই যুগে, এই নীরবতা ভাঙা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
ইতিহাসের পাতা ও আজকের বাস্তবতা
১৯৪৯ সালের ২রা ডিসেম্বর, যেদিন জাতিসংঘ মানব পাচার ও যৌন শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম কঠোর অবস্থান নিয়েছিল, সেদিনই এই লড়াইয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল। এটি কেবল অতীতের 'ক্রীতদাস' প্রথার বিরুদ্ধে নয়, বরং মানুষের মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া সব ধরণের শোষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। ২০০০ সালের প্রোটোকল এবং পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই লড়াই আরও জোরদার হয়েছে। আজকের এই দিনটি আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার অঙ্গীকার নবায়নের দিন।
২০২৫ সালে দাসত্বের আধুনিক রূপ: এক ভয়ঙ্কর চিত্র
আধুনিক দাসত্ব আজ আর শেকলে বাঁধা হাত-পায়ের ছবি নয়; এটি মিশে আছে আমাদের অর্থনীতিতে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। এর রূপগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম কিন্তু ধ্বংসাত্মক:
মানব পাচার: প্রায় ৬৩ লক্ষ মানুষ আজ পণ্যের মতো কেনা-বেচা হচ্ছে। এদের বড় একটি অংশ বাধ্য হচ্ছে যৌন পেশায় কিংবা হাড়ভাঙা খাটুনিতে।
জোরপূর্বক শ্রম: প্রায় ২ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের পরিহিত পোশাক থেকে শুরু করে খাবারের প্লেট—সরবরাহ শিকলের (Supply Chain) অন্ধকারের লুকিয়ে আছে এদের ঘাম ও রক্ত।
শৈশব চুরি: প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লক্ষ কন্যাশিশুকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে ৫৩ লক্ষ শিশু হাতে বইয়ের বদলে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল জনপদ জুড়ে এই হাহাকার আজ তীব্র।
পরিসংখ্যানের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস: সংকটের ব্যাপকতা
জাতিসংঘের তথ্যে উঠে এসেছে এক লোমহর্ষক চিত্র। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যা একেকটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া জীবন:
| জোরপূর্বক শ্রম | ২ কোটি ৭৬ লক্ষ | এশিয়া-প্যাসিফিক, আফ্রিকা |
| মানব পাচার | ৬৩ লক্ষ | ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য |
| জোরপূর্বক বিবাহ | ১ কোটি ২০ লক্ষ (প্রতি বছর) | দক্ষিণ এশিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকা |
| শিশু শোষণ | ৫৩ লক্ষ | সংঘাতপূর্ণ এলাকা |
অবাক করা বিষয় হলো, মানুষের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অপরাধীরা বছরে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার অবৈধ মুনাফা লুটছে।
কেন এই দিনটি আমাদের বিবেকে নাড়া দেওয়া উচিত?
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৮.৭ অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ব থেকে জোরপূর্বক শ্রম ও মানব পাচার নির্মূল করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ২০২৫ সালে জাতিসংঘের বার্তায় প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে—যাতে পাচারকারীদের শনাক্ত করা যায় এবং প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ষা করা যায়। এই দিনটি বিশ্বব্যাপী সংহতি প্রকাশের দিন, নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলার দিন।
দাসত্ব রুখতে আজই নিন ৭টি শপথ
আসুন, শুধু চেয়ে না দেখে পরিবর্তনের অংশীদার হই। এই দিবসে আপনার ছোট একটি পদক্ষেপও বড় পরিবর্তন আনতে পারে:
১. সহায়তার হাত বাড়ান: জাতিসংঘের ভিক্টিম ফান্ড বা বিশ্বস্ত কোনো এনজিওতে সাধ্যমতো অনুদান দিন।
২. আওয়াজ তুলুন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #EndSlavery2025 হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।
৩. সচেতন ক্রেতা হোন: 'গুড অন ইউ' (Good On You) এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করে জানুন আপনার প্রিয় ব্র্যান্ডটি জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার করছে কিনা। সন্দেহজনক ব্র্যান্ড বর্জন করুন।
৪. সোচ্চার হোন: মানব পাচার বিরোধী আইনের সমর্থনে পিটিশন বা গণস্বাক্ষরে অংশ নিন।
৫. চোখ কান খোলা রাখুন: আপনার আশেপাশে সন্দেহজনক কিছু দেখলে জাতীয় হটলাইনে রিপোর্ট করুন।
৬. ন্যায্য বাণিজ্যে সমর্থন: ফেয়ার-ট্রেড (Fair-trade) বা ন্যায্য বাণিজ্যের পণ্য কিনুন, যেখানে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা করা হয়।
৭. আলো ছড়ান: আপনার কমিউনিটি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে আলোচনা করুন, অন্যদের জানান।
আগামীর পথ: অন্ধকার পেরিয়ে আলোর সন্ধানে
আইনের ফাঁকফোকর, দুর্নীতি, এবং অভিবাসন সংকট এই লড়াইকে কঠিন করে তুলছে। ভয়ে অনেকে মুখ খোলে না, বিচার পায় না। তবুও এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ধারের ঘটনাগুলো আমাদের আশার আলো দেখায়। সরকার যদি ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন এবং ব্যবসায়িক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এই অভিশাপ অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারব।
আসুন, আজ একটি প্রতিজ্ঞা করি। দাসত্বমুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষে অন্তত একটি ভালো কাজ আজই শুরু করুন। এই লেখাটি শেয়ার করে আপনিও হয়ে উঠুন এই মানবিক যুদ্ধের একজন সৈনিক। মনে রাখবেন, মানুষের মুক্তিই মানবতার চূড়ান্ত বিজয়।